শীতকাল এলে সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে গলির মোড়, প্রায় সবখানে মধুর বিজ্ঞাপন চলতে থাকে। কত রকমের যে মধু হতে পারে, তা না দেখলে বোঝা কঠিন। প্রায় সব মধু বিক্রেতার মধুই শতভাগ ‘পিওর’। কারও কারও মধু তো সুন্দরবনের একমাত্র খাঁটি মধু! কারও মধু আবার সরিষা ফুল থেকে তৈরি! যা হোক, শীত মানে বঙ্গদেশে মধুর বাজারে চলে ভীষণ উত্তেজনা। আর দাম? সে তো আপনারা নিজেরাই জানেন।
আমাদের সবার কাছে প্রায় একই রকম তথ্য আছে, মধু হলো উত্তম মিষ্টিজাতীয় খাবার। তার ওপর আর মিষ্টি নেই! সেসব হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু তথ্য যদি বলে, মধুতেও বিষ থাকে! প্রথমে অবিশ্বাস্য, তারপর খতিয়ে দেখার চেষ্টা করবেন অনেকেই। হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন। মধুতেও থাকে বিষ। কিংবা মধুও হয় বিষাক্ত। কিন্তু সেটাও খাওয়া হয়। শত শত বছর ধরেই খাওয়া হয়।
একটা ছোটগল্প শোনাই। সে বহুকাল আগে, খ্রিষ্টপূর্ব ৪০১ সালের ঘটনা। গ্রিক সেনারা তুরস্কের ট্রাবজোন অঞ্চলে অভিযান চালাল; কিন্তু সেটা ঘটনা নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে সে রকম অভিযানের বহু গল্প আছে। এই অভিযান বিখ্যাত হয়ে আছে, সে অঞ্চলের এক বিশেষ মধুর কারণে। গ্রিক সেনারা ট্রাবজোন অঞ্চলে পাওয়া বিশেষ এক মধু খেয়ে বমি করতে শুরু করল। সেনাদের কেউ কেউ এতটাই মাতাল হয়ে পড়ল যে, তাদের মস্তিষ্কে ‘বিভ্রান্তি’ দেখা দিল। কেউ কেউ মৃত মানুষের মতো পড়ে রইল এবং তারপর যা হওয়ার তা-ই হলো, গ্রিকরা পরাজিত হলো। এ ঘটনার কথা লিখেছিলেন ঐতিহাসিক জেনোফন। সেটাই ছিল এ মধুর বিষক্রিয়ার প্রথম লিখিত বিবরণ।
সেই মধুর নাম ইংরেজিতে ‘ম্যাড হানি’ আর তুরস্কের আঞ্চলিক ভাষায় ‘দেলি বাল’। দেলি অর্থ পাগল, আর বাল অর্থ মধু। দুইয়ে মিলে ইংরেজিতে ম্যাড হানি আর বাংলায় পাগলা মধু।
সীমিত উৎপাদন
সেই মধুর নাম ইংরেজিতে ‘ম্যাড হানি’ আর তুরস্কের আঞ্চলিক ভাষায় ‘দেলি বাল’। দেলি অর্থ পাগল, আর বাল অর্থ মধু। দুইয়ে মিলে ইংরেজিতে ম্যাড হানি আর বাংলায় পাগলা মধু। পৃথিবীর খুব অল্প জায়গায় এই দেলি বাল কিংবা ম্যাড হানি নামের মধু উৎপাদন হয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, তুরস্কের কৃষ্ণসাগর অঞ্চল আর নেপালের পূর্ব হিমালয় অঞ্চলের কিছু জায়গায় এই মধু উৎপন্ন হয়। সম্প্রতি সিএনএনের সাংবাদিক মৌরিন ও’হেয়ার এ বিষয়ে একটি লেখা লিখেছেন। তিনি জানিয়েছেন, পৃথিবীর দুটি জায়গায় এই ‘বিরল মধু’ পাওয়া যায়। আবার কিছু সূত্র বলে, এই দুটি জায়গার সঙ্গে জর্জিয়া ও আজারবাইজানের ককেশীয় দেশগুলোতেও সীমিত পরিমাণে এই মধু উৎপন্ন হয়। মূলত যেসব পাহাড়ি জায়গায় রডোডেনড্রন ফুলের প্রাচুর্য আছে, সেসব জায়গায় ম্যাড হানি উৎপন্ন হয়। স্থানীয় পার্বত্য মৌমাছিরা রডোডেনড্রন ফুলের রস সংগ্রহ করে এই বিশেষ মধু তৈরি করে।
বিষাক্ত কেন
রডোডেনড্রন ফুলের পরাগ রেণু ও নেকটারে থাকে গ্রায়ানটক্সিন নামক এক ধরনের নিউরোটক্সিন। এটি মধুতে সঞ্চিত হয়। এই টক্সিনই ম্যাড হানির রহস্যময় ও বিপজ্জনক সব বৈশিষ্ট্য তৈরি করে।
এ মধুর স্বাদ কেমন
চেখে যেহেতু দেখা হয়নি, তাই নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে মধু যেহেতু, মিষ্টতা কিছু থাকবেই। তবে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, ম্যাড হানির স্বাদ তিতা বা টক অর্থাৎ, সাধারণ মধুর চেয়ে ভিন্ন। এর রং গাঢ় বাদামি বা লালচে রং।
এক দারুণ ঐতিহ্য
বিপদ যতই থাক, যারা এ মধু উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত তারা এটি চেখে দেখবে না, তা তো হয় না। ফলে নেপাল ও তুরস্কের কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে এ মধুকে কেন্দ্র করে শত শত বছর ধরে তৈরি হয়েছে ঐতিহ্য।
নেপালের গুরাং সম্প্রদায় ও তুরস্কের কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের স্থানীয় লোকেরা প্রজন্ম ধরে অল্প পরিমাণে ম্যাড হানি ঔষধি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। তারা এটিকে পেটের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এমনকি যৌনশক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যবহার করে। তবে এর ব্যবহার সব সময়ই একটি জটিল রীতিনীতি ও পরিমিতিবোধের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়।
এটাও বলে রাখি, কিছু মানুষ এটিকে ‘হানি হাই’ বা নেশার জন্যও ব্যবহার করে।
পরিমাণের বেশি খেলে কী হতে পারে?
বিপদ আছে। যেকোনো খাবারই পরিমাণের বেশি খেলে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু এই ম্যাড হানি স্বল্প মাত্রায় খেলেও হতে পারে হালকা ইউফোরিয়া, স্নায়বিক শিথিলতা বা বমি বমি ভাব। আর উচ্চ মাত্রায় খেলে? সে তালিকা বেশ লম্বা।
তবে হ্যাঁ, প্রাকৃতিক এই উত্তেজকের জন্য আছে প্রাকৃতিক চিকিৎসা। জানা যাচ্ছে, সাধারণত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে লক্ষণগুলো নিজে থেকে কমে যায়। তবে গুরুতর ক্ষেত্রে হাসপাতালে চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে।
বলে রাখা ভালো, এটি বেশির ভাগ দেশে অবৈধ নয়। তবে বিক্রি বা বিপণনে নিয়ন্ত্রণ আছে।
আধুনিক বাণিজ্য ও অপব্যবহার
বিশেষ কিছু অঞ্চলের মানুষদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পরিচালিত জ্ঞানের মাধ্যমে যে মধু একসময় ছিল বিশেষ, সে মধুই এখন ‘অনলাইন পণ্যে’ পরিণত হয়েছে। ফলে চাহিদা বেড়েছে স্বাভাবিকভাবে। নেপাল ও তুরস্ক থেকে এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘এক্সোটিক হানি’ বা ‘সাইকোঅ্যাকটিভ হানি’ হিসেবে বিক্রি হয়। পর্যটকদের মধ্যে এটি খাওয়া একটি ‘অভিজ্ঞতা’ হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, বিশেষ করে নেপালের অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে। আর এ চাহিদা বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে ভেজাল ম্যাড হানির পরিমাণ।
বৈচিত্র্যপিয়াসীরা ভেজাল না খেয়ে আসলের সন্ধান করতে পারেন।
সূত্র: