বিরাট বিরাট কংক্রিটের ভিড় তখনো জমেনি বাংলার শহর, গঞ্জ, মফস্বলে। তাই তো কাশফুলে ভরা মাঠ পেরিয়ে অপু-দুর্গা ছুটেছিল রেলগাড়ি দেখতে। অথচ বাঙালিকে আজ সেই কাশফুল দেখতেই শহর ছাড়িয়ে ছুটতে হয় প্রত্যন্ত গ্রামে! যেখানে আজও কাশের দল বেঁচে থাকার লড়াই করছে। উন্নয়ন আর সভ্যতার জাঁতাকলে ঘন কাশের বন আর কোথায় পাওয়া যাবে!
কবির চোখে শরৎ
শরৎ আসে নিঃশব্দে, যেন কোনো কবি প্রকৃতির বুকে লিখে যায় প্রেমের গোপন চিঠি। চোখে নরম আলো, হাতে একগুচ্ছ কাশফুল। আকাশে নীলের গভীরতা, মেঘের তুলোছোঁয়া আর বাতাসে এক অদ্ভুত মুগ্ধতা—সব মিলিয়ে শরৎ যেন এক স্বপ্নের ঋতু। আকাশ নীল হয়, এতটাই নীল যে চোখে জল আসে। এমন রং তো শুধু ভালোবাসারই হয়। সংস্কৃত কবি কালিদাস শরৎকে নববধূর মতো সাজানো রূপে দেখেছেন—
‘কাশফুলের মতো যার পরিধান, প্রফুল্ল পদ্মের মতো যার মুখ
শরৎ যেন নববধূ, যার নূপুরের শব্দ উন্মত্ত হাঁসের ডাকের মতো রমণীয়।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখে শরৎ ঋতু ছিল এক অপার সৌন্দর্যের প্রতীক—নির্মলতা, শান্তি ও আধ্যাত্মিকতার এক অনন্য প্রকাশ। তিনি শরতের রূপ-অপরূপকে শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য হিসেবে দেখেননি, বরং তা তাঁর ভাবনার গভীরে ছুঁয়ে গেছে।
লিখেছেন, ‘আজি শরততপনে প্রভাতস্বপনে কী জানি পরান কী যে চায়।
ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে বিহগ বিহগী কী যে গায় গো।’
শরতের প্রকৃতি
ভাদ্র ও আশ্বিন মাস নিয়ে শরৎকাল, যা বর্ষার পরই প্রকৃতিতে এক শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশ নিয়ে আসে। শরতে মেঘেরা ভেসে বেড়ায়, তুলোর মতো হালকা, বাতাসে থাকে এক মিষ্টি শীতলতা, যা একেবারে হৃদয়ে লাগে। কাশফুলেরা মাথা নাড়ে, যেন তারা গান গায়—এসো, একটু থেমে যাও, একটু ভালোবাসো।
সোনালি বিকেলে রোদ যেন নিজেই গলে যায়; এমন বিকেলে মন কেমন করে ওঠে। পুরোনো স্মৃতিতে ভর করে আসে ছোটবেলার খেলার সাথিরা। দুপুর গড়াতেই ওদের হাঁকডাক পড়ে যেত। আর পড়ত রাত পোহানো শারদ সকালে সাজি ভরে শিউলি কুড়ানোর ধুম! খুব সন্তর্পণে গাছে ঝাঁকি দিলেই ওপাশ থেকে আন্টির চোখরাঙানো ধমক! আহা কী মায়া সেসব দিনের!
শহুরে শরত
ভাদ্র মাস শেষ হলেই আকাশের রং ক্রমে উজ্জ্বল আকাশি-নীলে বদলে যায়। আকাশের সেই রংবদল আজও হয়। কিন্তু শহরে তা ঢাকা পড়ে যায় কালো ধোঁয়া আর দূষণে। বহুতল ভবন আড়াল করে দেয় পেঁজা তুলোর মেঘের ভেলা! ফ্ল্যাটবাড়ির সৌজন্যে বাঙালি বাড়ির উঠোন আজ আর নেই বললেই চলে। একসময় এই ঋতুতে বাড়ির উঠোনে জবা, টগরের সাথে ফুটত শিউলি। সেই ফুল ঝরে পড়ত আটপৌরে উঠোনে। বাড়িময় গন্ধে ম-ম করত। সময়ের পালাবদলে ব্যালকনির টবে এখন ভিনদেশি ক্যাকটাস ফুল ফোটে! সেখানে শিউলির ঘ্রাণ অলীক স্বপ্ন! তবু শরত এলে পথে-ঘাটে কোথাও কোথাও শিউলির ঘ্রাণ ভেসে আসে থেকে থেকে; মনকে উদাস করে তোলে!
প্রেম ও প্রতীক্ষার ঋতু
শরত শুধু ঋতু নয়, সে এক প্রেম, এক প্রতীক্ষা, এক নান্দনিকতার উৎস। এই ঋতু যেন কবিতার শরীর, যার প্রতিটি ভাঁজে লুকিয়ে থাকে শব্দের সৌন্দর্য। শরৎ মানেই কাশফুলের মাঠ, নদীর ধারে হাঁটা আর প্রেমের গোপন আলাপ। বিকেলের নরম আলোয় হাত ধরে হাঁটা, কাশফুলের পাশে বসে গল্প বলা কিংবা ছাদে বসে চা খাওয়ার মুহূর্তগুলো যেন আরও বেশি হৃদয়ছোঁয়া হয়ে ওঠে। ছাদে বসে চায়ের কাপ হাতে, চোখে চোখ রেখে বলা যায় না বলা কথাগুলো; শরতের হাওয়া প্রেমের আবহকে করে তোলে আরও গভীর, আরও রোম্যান্টিক।
উৎসব ও কোলাহলের ঋতু
শরৎ শুধু কবিতায় নয়, বাংলার সংস্কৃতিতেও এক গুরুত্বপূর্ণ সময়। দুর্গাপূজা শরতের সবচেয়ে বড় উৎসব। এই ঋতুতেই লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা ও ভাইফোঁটার মতো বিভিন্ন আনন্দময় উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাঙালিদের কাছে দুর্গাপূজা কেবল একটি উৎসব নয়; এ যেন একগুচ্ছ স্মৃতি আর নস্ট্যালজিয়া। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বদলে গেছে বটে, কিন্তু কিছু কিছু মুহূর্ত আজও আমাদের মনকে সেই পুরোনো দিনগুলিতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। শারদোৎসবের মুহূর্তগুলি ঠিক তেমনই। কত পুরোনো কথাই না মনে পড়ে যায়! পূজার ছুটি, ঢাকের শব্দ, ধূপের গন্ধ, নাড়ু, মোয়া-মুড়কি আরও কত কী! বাঙালি যতই বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠুক, মহালয়া আজও তাকে মনে করিয়ে দেয়, কোথায় রয়েছে তার শেকড়। মহালয়ার ভোরে ঘড়িতে চারটে বাজলেই বেজে ওঠে কীর্তন মহিষাসুরমর্দিনী। এ সময় বাঙালির পোশাক, খাদ্য, গান, নাটক—সবকিছুতেই থাকে শরতের ছোঁয়া। পোশাকের ভাবনায় শরত আনে হালকা পরিবর্তন। গরমের তীব্রতা কমে যাওয়ায় এখন হালকা সুতির সঙ্গে মিক্স ফ্যাব্রিকের পোশাক চলে আসে। মেয়েদের জন্য হালকা রঙের শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, ছেলেদের জন্য লিলেন বা কটনের পাঞ্জাবি—সবকিছুতেই থাকে একধরনের নান্দনিকতা। শরতের উৎসব, বিশেষ করে দুর্গাপূজা, এই পোশাক ভাবনাকে আরও রঙিন করে তোলে। কাশফুল, শিউলি বা দুর্গাপূজার মোটিফ চোখে পড়ে পোশাকের আবহে। সাজগোজের অঙ্গ হিসেবে আলতার প্রচলন আজকের নয়। পূজা-পার্বণ হোক অথবা নৃত্যশিল্পের অংশ—আলতা সবকিছুর সঙ্গেই জড়িত ওতপ্রোতভাবে।
ঘুরে বেড়িয়ে ফুরফুরে
বেড়ানোর জন্যও শরৎ এক দারুণ সময়। শহরের বাইরে, নদীর ধারে কিংবা পাহাড়ের কোলে শরতের প্রকৃতি যেন ডাকে। এই ঋতুতে ভ্রমণ মানেই শুধু জায়গা দেখা নয়, বরং অনুভব করা যায় প্রকৃতির সৌন্দর্যকে। পূজার ছুটি মানেই অনেকের কাছে বেড়াতে যাওয়া। শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও পাড়ি দেওয়ার এক সুবর্ণ সুযোগ। কিন্তু শেষ মুহূর্তে প্ল্যান করলে বাজেট বেড়ে যাওয়ার ভয় থাকে, তাই আগে থেকেই প্ল্যান করা—যেন ছুটি হলেই বেরিয়ে পড়া যায় দিন পাঁচেকের জন্য সব দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করে। পূজা মানেই যে বাইরে ঘোরাঘুরি বা ঠাকুর দেখতে যেতেই হবে—এমন কোনো কথা নেই। অনেকেই উৎসবের দিনগুলো কাটিয়ে দিতে চান মনের মতো করে আলসেমিতে, বাড়ির চেনা পরিসরে। তাতে যেমন ভিড় এড়িয়ে শান্তি পাবেন, তেমনি পরিবারের সঙ্গে একটানা অনেকটা সময় কাটানোর সুযোগও মিলে যাবে।
ছবি সৌজন্য: বিশ্বরঙ