স্থাপত্যের জগতে এখন সম্ভবত জাপান যুগ চলছে। কিংগো কুমা, টাডাও আন্দো, শিগেরু বানসহ আধুনিক স্থাপত্যের গুরুদের সাতটি অনন্য সৃষ্টি যেন সে কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে বিশ্ববাসীকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহ্য ও আধুনিক প্রযুক্তি একসঙ্গে মিলে অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা তৈরি করছে জাপানিজ আধুনিক স্থাপত্যকলায়। জাপানে ভ্রমণের পরিকল্পনা থাকলে এই স্থাপত্যগুলোকে নিজের চোখে দেখা মিস করবেন না।
নিশ্চুপ পাহাড়ি গ্রাম থেকে শুরু করে টোকিওর স্টেডিয়ামের কেন্দ্র পর্যন্ত প্রতিটি স্থাপত্য যেন একেকটি ধ্যানমগ্ন উপাখ্যান। সেখানে আলো-ছায়া, বাতাস, কাঠ আর কংক্রিট একসঙ্গে বলে চলে নীরব গল্প। জাপানি স্থাপত্য উচ্চকিত নয়, ধ্যানস্থ। তারা চিৎকার করে জানান দেয় না নিজেদের অস্তিত্ব। কিন্তু একবার যদি তাতে চোখ পড়ে, দেখবেন, প্রতিটি রেখা, প্রতিটি কণা, প্রতিটি আলো-ছায়া আপনাকে শেখাচ্ছে, কীভাবে শিকড়ের মধ্যে ভবিষ্যতের বীজ লুকিয়ে থাকে।
ইউসুহারা গ্রাম
কোচি পর্বতের কোলে অবস্থিত ইউসুহারা গ্রাম। গ্রামটি পরিণত হয়েছে এক স্থাপত্য ল্যাবরেটরিতে। ১৯৯৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে স্থপতি কিংগো কুমা এখানে ছয়টি ভবন নির্মাণ করেন; যেগুলো একত্রে মনে হয় যেন একটি জাপানি লেগো সেট। সেখানে টাউন হল মোড়ানো হয়েছে সিডার কাঠে। জাদুঘরটি যেন একটি ঝুলন্ত সেতু আর লাইব্রেরি দেখলে মনে হবে একটি বনভূমি। প্রতিটি ভবনে ব্যবহৃত হয়েছে প্রাচীন জাপানি নির্মাণকৌশলের আধুনিক রূপায়ণ, যা একে বানিয়েছে দেশটির অন্যতম স্থাপত্যশিল্প গ্রাম।
চার্চ অব লাইট
ওসাকার উপশহরের এক নিঃসঙ্গ কংক্রিটের বিল্ডিং। এর মধ্যে এক আধ্যাত্মিক বিস্ময় লুকিয়ে রয়েছে। এটি মূলত একটি চার্চ। বেদির পেছনে শুধু একটি ক্রস আকৃতির ফাটল, যা দিয়ে আলো ঢুকে তৈরি করে এক অলৌকিক পরিবেশ। ওই সূক্ষ্ম আলোকরেখায় কেটে যায় অন্ধকার। সেখানে কোনো অলংকরণ নেই। এর স্থপতি টাডাও আন্দো প্রমাণ করেছেন, কোনো গির্জার বিশাল গথিক কারুকাজের চেয়ে কখনো কখনো একটি ফাটল বেশি আবেগ জাগাতে পারে।
তাকাসুগি-আন টি-হাউস
নাগানোর পাহাড়ে দাঁড়িয়ে এক অদ্ভুত ও রূপকথার মতো টি-হাউস তাকাসুগি-আন। তাকাসুগি-আন শব্দটির অর্থ ‘অতিরিক্ত উঁচু বাড়ি’। ৬ মিটার ওপরে দুটি বাদাম কাঠের গুঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে বাড়িটি। এখানে উঠতে হয় একটি মই বেয়ে। ওঠার পর সেখানে চা পানের ব্যবস্থা আছে। এটি যেন স্টুডিও জিবলির কোনো চলচ্চিত্র থেকে উঠে আসা কবিতার ঘর।
চিচু আর্ট মিউজিয়াম
নাওশিমা দ্বীপে স্থাপত্যের ধারণা যেন পুরোপুরি বদলে দিয়েছেন টাডাও আন্দো। চিচু মিউজিয়াম গড়া হয়েছে মাটির নিচে। এর বাইরে থেকে কোনো কিছু দৃশ্যমান নয়, শুধু আকাশ থেকে দেখা যায় কিছুটা। এখানে সূর্যালোক পড়ে কৌণিকভাবে। তাতে জীবন্ত হয়ে ওঠে ক্লদ মনেট, জেমস টারেল ও ওয়াল্টার ডি মারিয়ার কাজ। এখানকার একটি ত্রিভুজাকৃতি সিঁড়ি আপনাকে নিয়ে যাবে এমন এক ঘরে, যেখানে মনেটের জলবৃক্ষের চিত্রকর্ম যেন প্রতিনিয়ত বদলে যায় আকাশের আলোয়। এখানে স্থাপত্য নিজেই এক শিল্পকর্ম।
ওইটা প্রিফেকচারাল আর্ট মিউজিয়াম
ওইটা শহরে এই শিল্পকেন্দ্র তৈরি করেছেন শিগেরু বান। প্রাচীন জাপানি বাড়ি ‘এনগাওয়া’র করিডর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করা হয়েছিল জাদুঘরটির নকশা। এখানে দর্শনার্থী ও শহরের মানুষের মধ্যে একটি মুক্ত সংলাপ তৈরি হয়। ওপরের কাঠামোতে ব্যবহৃত বাঁশের নকশা স্থানীয় কারুশিল্পের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বিষয়টি আধুনিক স্থাপত্যে এনেছে এক পরিশীলিত ঐতিহ্য।
এনওরা অবজারভেটরি
সাগামি উপসাগরের এক খাড়া পাহাড়ে বিজ্ঞান আর কবিতার যুগলবন্দী এনওরা অবজারভেটরি। এনওরা অবজারভেটরিতে চিত্রশিল্পী হিরোশি সুগিমোতো নির্মাণ করেছেন এক আধুনিক মন্দির। ১০০ মিটার দীর্ঘ গ্যালারিতে সূর্যের আলো পড়ে ধীরে ধীরে গ্রীষ্মের দিক নির্দেশ করে। অপর দিকে ৭০ মিটার একটি সুড়ঙ্গ চিরে ঢোকে শীতকালীন সূর্য। আর সমুদ্রের ওপর ভেসে থাকা কাচের মঞ্চে একটি পাথরের নো থিয়েটার।
জাপান ন্যাশনাল স্টেডিয়াম
২০২০ অলিম্পিকের জন্য নির্মিত টোকিওর এই স্টেডিয়াম যেন একটি বন। কিংগো কুমা এখানে তৈরি করেছেন কাঠ ও স্টিলের বিশাল ছাদ, যেখানে হাজার হাজার সিডার কাঠের পাত লেগেছে। এই কাঠগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল জাপানের ৪৭টি প্রদেশ থেকে। পুরোনো মন্দিরের মতো এখানে আলো-ছায়ার খেলা, শীতলতা ও মানবিকতা—সবকিছু মিশে আছে। এই ৬০ হাজার আসন বিশিষ্ট স্টেডিয়ামের প্রযুক্তিনির্ভর গম্বুজের নিচে রয়েছে ঝুলন্ত বাগান, যা একে একুশ শতকের টেকসই স্থাপত্যের প্রতীক করে তুলেছে।
সূত্র: ইএন ভোলস