ঢাকায় জন্মগ্রহণ করা এবং বেড়ে ওঠা মাহিমা ফেরদৌসী মিথিলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। উদীয়মান এই চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি অধ্যয়নরত। তাঁর গবেষণার মূল ক্ষেত্র চিকিৎসা নৃবিজ্ঞান। বিশেষভাবে তিনি বহুমূত্র রোগ (ডায়াবেটিস) ও বায়োমার্কারকে কেন্দ্র করে মানবস্বাস্থ্য, সংস্কৃতি ও জৈবিক উপাদানের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে কাজ করছেন। বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি, চ্যালেঞ্জ ও অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন তিনি। অনুলিখন মো. আশিকুর রহমানের।
নৃবিজ্ঞান বেছে নেওয়ার কারণ
বাংলাদেশে নৃবিজ্ঞান এখনো তুলনামূলকভাবে অপরিচিত বিষয়। মিথিলা বলেন, ‘উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানের অতিরিক্ত চাপ নিতে না পেরে এমন একটি বিষয় খুঁজছিলাম, যেখানে পাস-ফেলের ভয় থাকবে না।’ তবে পুরো স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম হওয়া তাঁর ‘চাপমুক্ত পড়াশোনা’র পরিকল্পনায় কিছুটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর ভাষায়, নৃবিজ্ঞানে শূন্য পাওয়া কঠিন হলেও ১০/১০ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ক্লাস নোট, বাংলা ও ইংরেজি নানা সোর্স ঘেঁটে পড়াশোনা করা এবং পরীক্ষার হলে সময় ব্যবস্থাপনা—এই তিনটি বিষয় তাঁকে এগিয়ে রেখেছে।
মিথিলা মনে করেন, এই বিষয়ে পড়াশোনার মাধ্যমে সমাজের বৈচিত্র্যময় দিকগুলোর প্রতি সহনশীলতা বেড়েছে, সংস্কৃতির আলোচনায় দক্ষতা অর্জন করেছেন। গোল্ড মেডেল ও ডিনস অ্যাওয়ার্ড—এই স্বীকৃতির দিনগুলো তাঁর জীবনের স্মৃতির খাতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এসব অর্জন তাঁকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে, ‘আমি না পারলে আর কে পারবে?’
হঠাৎ বদলে যাওয়া সিদ্ধান্ত
মিথিলা বলেন, শুরুতে পরিকল্পনা ছিল যুক্তরাজ্যে যাওয়ার। তবে হঠাৎ মনে হলো, যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী শিক্ষার্থীদের জন্য এখন সবচেয়ে কঠিন সময়। এই সময়ে দেখি ফান্ড পাই কি না। নিজের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন মিথিলা। সবকিছু ঠিক থাকলেও পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ হয়নি, যা কষ্টের ছিল। তবু নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন। কারণ, যখন চেয়েছেন, তখনই যুক্তরাষ্ট্রে আসতে পেরেছেন।
প্রফেসর নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বড় কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। মিথিলার মতে, যাঁরা নির্দিষ্ট কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চান, তাঁদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিত। না হলে সেখানে টিকে থাকা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। প্রস্তুতি আগেভাগে গুছিয়ে নেওয়া জরুরি। তাড়াহুড়ো করলে যেমন ভুল হয়, তেমনি আশানুরূপ ফলও আসে না।
গবেষণার বিষয়
বর্তমানে মিথিলা চিকিৎসা নৃবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করছেন এবং গবেষণার বিষয় হিসেবে ডায়াবেটিসকে চূড়ান্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই রোগের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বই এই ‘নীরব ঘাতক’ রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এ ক্ষেত্রে গবেষণার মাধ্যমে সামান্য অবদান রাখতে পারলেও সেটাই তাঁর কাছে বড় প্রাপ্তি।
ভয় যেভাবে করেছেন জয়
বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে সবচেয়ে বড় বাধা হলো ভয়। ভয় পেলে ইন্টারভিউ ভালো হয় না, কাগজপত্রের ঝামেলায় ঘাবড়ে যেতে হয়। তাই ভয় কমাতে হবে। তাঁর মতে, সঠিক গাইডলাইন ও পর্যাপ্ত তথ্য ঘাঁটাঘাঁটি করলে ভয় অনেকটা কমে। নিজের ফিল্ডের কোনো সিনিয়রের সঙ্গে আলোচনা করলে বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়। আর্থিক বিষয়ে তিনি বলেন, ফুল ফান্ডেড প্রোগ্রামে বড় কোনো খরচ থাকে না। যেটুকু হয়, সেটাও ধার করে শোধ করা সম্ভব। পুরো প্রক্রিয়ার জন্য অন্তত এক বছর সময় নিয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দেন।
কাছের মানুষের অনুপ্রেরণা
মিথিলার পথচলায় সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা তাঁর বাবা। তিনি সব সময় বলতেন, আমেরিকায় গিয়ে এটা করা যাবে না, সেটা করা যাবে না। সেই নিষেধই যেন তাঁকে আমেরিকায় পৌঁছে দিয়েছে। ইন-লজরা তাঁর পড়াশোনায় সব সময় উৎসাহ দিয়েছেন। স্বামী যেভাবে প্রয়োজন হয়েছে, ঠিক সেভাবেই পাশে দাঁড়িয়েছেন। মা ও বোন সময়-সময় সাহস জুগিয়েছেন। পাবলিক স্পিকিংয়ে সব সময় আতঙ্ক ছিল তাঁর। প্রেজেন্টেশনে তাঁর বন্ধুরা অনেক সময় ভরসা হয়ে উঠেছে। সিনিয়র ভাই-আপুদের দিকনির্দেশনা, শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের স্নেহ—সবকিছুর কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন মিথিলা।
আগ্রহীদের জন্য পরামর্শ
মাহিমা ফেরদৌসী মিথিলার মতে, আমেরিকায় যাওয়া এবং সেখানে টিকে থাকতে হলে ধৈর্য ও পরিশ্রমের বিকল্প নেই। ফল একটু খারাপ হলেও পছন্দের ফিল্ডে কাজের অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। তিনি বলেন, মানবিক ও সমাজবিজ্ঞানের স্কোপ স্টেমের তুলনায় কম হলেও সুযোগ একেবারে কম নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আশা হারানো যাবে না। লেগে থাকতে হবে, তাহলেই পথ খুলবে।