ভ্রমণ আর সেই ভ্রমণে নতুন নতুন জায়গা দেখা নিয়ে আমার ইচ্ছার যেন কোনো শেষ নেই! কখনো মনে হয়, নতুন কোনো পাহাড় দেখতে পারলে বেশ হতো, কখনো নতুন একটা সমুদ্রতট বা কখনো অদেখা অরণ্য আমাকে টানে। কখনো হয়তো নতুন কোনো জলপ্রপাত আমাকে লোভী করে তোলে। আবার হয়তো একেবারেই অভিনব কোনো জলাশয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এবার যখন ভারতের মেডিকেল ভিসা ও অফিসের ছাড়পত্র পেলাম, তখন শুরুতেই আমার মাথায় এল ভেলোর যাব। কিন্তু সোজাসুজি যাব না। আর হাতে যেহেতু বেশ কয়েক দিন সময় আছে, তাই একটু ঘুরপথে, নতুন কিছু দেখতে দেখতে, অভিজ্ঞতা নিতে নিতে, নতুন নতুন অনুভূতির স্বাদ নিতে নিতে ভেলোর যাব। যে নতুন জায়গাগুলো দেখতে চেয়েছিলাম, তার মধ্যে অন্যতম আর প্রথম ছিল ভারতের সবচেয়ে বড় এই হ্রদ চিলিকা দেখা।
চিলিকা নামের এই হ্রদ ভারতের সমুদ্র ও পাহাড় দিয়ে ঘিরে থাকা রাজ্য ওডিশার পুরীতে। চিলিকা লেকের একদিকে সমুদ্র, একদিকে পাহাড়। একদিকে সমতল ভূমি, আর বেশ কিছুটাজুড়ে মাঝারি পাহাড় দিয়ে ঘেরা এই হ্রদ আয়তনে এতটাই বিশাল যে, দূরত্ব দিয়ে আর কিলোমিটারে হিসাব করলে প্রায় পুরো বাংলাদেশ এই হ্রদের মধ্যে অনায়াসে এঁটে যাবে! জি হ্যাঁ, এতটাই বিশাল এর পরিধি। লম্বায় ১ হাজার ১৬৪ কিলোমিটার—এই হ্রদের বিস্তার ওডিশা রাজ্যের তিনটি জেলাকে কেন্দ্র করে। যেখানে আমাদের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার দূরত্ব প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার। কোথাও কোথাও এর ব্যাস ৫০ কিলোমিটারেরও ওপরে!
ঢাকা থেকে রাতের বাসে কলকাতা পৌঁছে, সন্ধ্যা নাগাদ হাওড়া থেকে ধরেছিলাম পুরীর ট্রেন, যেটা সকাল হয়ে যাওয়ার আগেই পৌঁছে যাবে পুরীতে। এসি ওয়েটিং রুমে ফ্রেশ হয়ে নিয়েই একটা অটো ভাড়া করে নিলাম পুরী থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরের চিলিকায় যাওয়ার জন্য। শর্ত ছিল, সে অটোওয়ালা আমাকে ফিরিয়েও আনবেন যত সময় আমি চিলিকায় থাকব তত সময় অপেক্ষা করে। ভাড়া ঠিক করেছিলাম ৭০০ রুপিতে। কাক ডাকা ভোরে বের হয়েছিলাম চিলিকার পথে। শহুরে পুরী পেরিয়েই দেখা পেয়েছিলাম সবুজে ঘেরা এক চমৎকার মিহি সকালের। ঝিরিঝিরি বাতাস গায়ে মেখে, সবুজে সবুজে চোখ বুলিয়ে, নানা রকম জলাশয়ে মুগ্ধ হয়ে, সাদা শাপলার রাজ্য পেরিয়ে সকাল ৭টা নাগাদ পৌঁছে গিয়েছিলাম চিলিকার তীরে।
যার যেভাবে খুশি, সেভাবে উপভোগ করতে পারে চিলিকার বিস্ময়। চেখে দেখতে পারে নানা রকম মাছের ভাজা, রান্না বা বারবিকিউ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপভোগ করা যায় চিলিকার নানা রকমের ঝিলিক, দেখা যায় শত রকমের পাখিদের ঝাঁক, পানকৌড়ির ভেসে বেড়ানো, সাদা বকেদের দলের দেখা মেলে যেখানে-সেখানে। প্রকৃতির কাছ থেকে যত রকমের বৈচিত্র্য আমরা চাইতে পারি, শুধু বরফে মোড়া হিমালয় ছাড়া দেখতে পাওয়া যায় বাকি সবকিছুই এই চিলিকা হ্রদের জলে ভেসেই!
আমি অবশ্য নিয়েছিলাম ভিন্ন পন্থা। সন্ধ্যা হলেই এসি ট্রেনের কামরায় চড়ে ঘুমিয়ে পড়া, আর সকালে নতুন একটা জায়গায় গিয়ে সারা দিন নতুন কিছু উপভোগ করা। চিলিকার ঝিলিকের পর আমি পরদিন গিয়েছিলাম ওডিশার কোরাপুট, যা আমার কাছে দার্জিলিংয়ের চেয়েও অনবদ্য ও আকর্ষণীয় লেগেছে।