সুকুমার রায়ের সেই তৃষ্ণার্ত পথিকের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। সেই যে প্রচণ্ড তৃষ্ণায় পানি চাইতে যিনি অনেক মানুষের কাছে গিয়ে বিফল হয়ে শেষ পর্যন্ত পড়েন এক বিজ্ঞানীর হাতে। তৃষ্ণার্ত পথিককে তখন বিজ্ঞানী শুনিয়ে চলেছিলেন বিশুদ্ধ আর দূষিত পানির কাহিনি। হ্যাঁ, পানি হলেই জীবন বাঁচে না। জীবন বাঁচে বিশুদ্ধ পানিতে।
প্রবল বন্যা হলেই কেবল গ্রামাঞ্চলে পানি ফুটিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে বিশুদ্ধ করে পান করার চল। কিন্তু শহরগুলোর ব্যাপার ভিন্ন। পানিবাহিত রোগের প্রকোপ শহরাঞ্চলে সম্ভবত গ্রামের চেয়ে বেশি।
একটা সময় ছিল যখন পানি বিশুদ্ধ করার নিয়ম বড় বড় করে বিলবোর্ডে ছাপা হতো কিংবা বিজ্ঞাপন আকারে ছাপা হতো পত্রিকার পাতায়। এখন সেদিন না থাকলেও পানি ফুটিয়ে বিশুদ্ধ করার আয়োজন নেহাত কম নয়। কমবেশি ১৫ মিনিট ধরে উচ্চতাপে ফুটিয়ে নিয়ে প্রথমে ঠান্ডা করতে হয়। তারপর সেই পানি পান করা যায়।
পানি বিশুদ্ধ করে না খেলে টাইফয়েড, আমাশয়, ডায়রিয়া ও জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া পেটের রোগেও ভুগতে হয় প্রায়ই। তাই এসব রোগ-বালাই দূরে রেখে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে চাইলে পানি বিশুদ্ধ করতেই হয় যেকোনো উপায়েই হোক না কেন।
পানি বিশুদ্ধকরণের সহজ দুটি উপায় হলো ওয়াটার ফিল্টার ও ওয়াটার পিউরিফায়ার ব্যবহার করা। এ দুটির কাজের ধরন ভিন্ন।
পানিতে থাকা ক্লোরিনের গন্ধ, দুর্গন্ধ, ময়লা, পলি, গাদ, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস দূর করে ওয়াটার ফিল্টার। তবে ভারী খনিজ ও রাসায়নিক পদার্থ দূর করার ক্ষেত্রে সাধারণ ফিল্টারের সক্ষমতা কম। ফিল্টারের মধ্যে থাকে অ্যাকটিভেটেড কার্বন। ফিল্টারেশনের সময় এই কার্বন পানিতে থাকা সাবান বা ডিটারজেন্টের অস্তিত্ব দূর করে। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দূষিত কণা শুষে নিয়ে পরিশোধিত পানি পানের সুযোগ দেয়।
ওয়াটার পিউরিফায়ার
পানি যে পাইপের মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছায়, তাতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মরিচা পড়ে। পানি থেকে ভারী খনিজ পদার্থ, পানিতে মিশে যাওয়া ধাতু, আর্সেনিক, পারদ, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দূর করতে ভালো মানের পিউরিফায়ার ব্যবহার করা যেতে পারে। পানির সাধারণ ফিল্টার এই রাসায়নিকগুলো দূর করতে পারে না।
পানিতে টোটাল ডিসলভড সলিডের (টিডিএস) মাত্রা কম হলে সাধারণ পিউরিফায়ার দিয়েই কাজ চালানো যাবে।
নোনতা স্বাদ দূর করার ক্ষেত্রে পিউরিফায়ার নির্মাতা ব্র্যান্ডগুলো রিভার্স অসমোসিস (আরও) প্রযুক্তিসংবলিত ওয়াটার পিউরিফায়ার কেনার পরামর্শ দিয়ে থাকে। তাদের দাবি, ইলেকট্রিক পিউরিফায়ার পানিতে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামও যোগ করে থাকে। ইলেকট্রিক ওয়াটার পিউরিফায়ারে পানি ঢালার কোনো প্রয়োজন হয় না। বাটন অন করলেই বিশুদ্ধকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। এগুলোতে পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য রিভার্স অসমোসিস বা আরও এবং ইউভি প্রযুক্তি যুক্ত থাকে।
এখনকার স্মার্ট ওয়াটার পিউরিফায়ারে রিভার্স অসমোসিস (আরও), অতিবেগুনি রশ্মি ও মাইক্রো ফিল্টারেশন প্রযুক্তি থাকে। ব্র্যান্ডভেদে এসব পিউরিয়াফার কিনতে অন্তত সাড়ে ১৪ হাজার টাকা খরচ হবে। এগুলো বেশ কয়েকটি ধাপে পানি বিশুদ্ধ করে।
ইলেকট্রিক পিউরিফায়ারের (আরও, ইউভি, এমএফ প্রযুক্তিসংবলিত) একটি সুবিধা হচ্ছে–একবার বাটন চাপলে পানি পড়তে থাকে। নব ধরে রাখার প্রয়োজন পড়ে না। আবার বন্ধ করার বাটন না চাপা পর্যন্ত টানা ৫ লিটার পানি পড়বে। অন্ধকারেও পানি নেওয়ার সুবিধা আছে এগুলোতে। মধ্যরাতে পানি খাওয়ার জন্য গ্লাস বা জগ ধরে রাখার জায়গার ওপরেই আলোর ব্যবস্থা আছে। ফলে ঘরের আলো জ্বালানোর প্রয়োজন পড়ে না।
পানির ফিল্টারের কার্যকারিতা সম্পর্কে ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. শুভাগত চৌধুরী বলেন, ‘সাধারণ জীবনের জন্য এগুলো নিরাপদ বটে। আমরা যে ধরনের পানি পাই, তাতে ফিল্টার ব্যবহার করা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ও নেই। পৃথিবীতে অসংখ্য সূক্ষ্ম ভাইরাস আছে। কোনো ফিল্টারই এগুলো শতভাগ মারতে পারে না। যতটুকু পরিশোধিত হয়, ততটুকুই নিরাপদ ধরে সাধারণ জীবন যাপন করতে হবে। এমনিতে কলের পানির চেয়ে ফিল্টারগুলো ভালো কাজ করে। ফুটিয়েও সব সময় পানি খাওয়া সম্ভব নয়। তাই ফিল্টার ব্যবহার করা সুবিধাজনক।’
পিউরিফায়ারেই পানি গরম
এখন যুগ মিনিমালিজমের। তাই পানির ফিল্টারের মধ্যেই যোগ করা হয়েছে পানি গরমের প্রযুক্তি। শাওমি কোম্পানির ইনস্ট্যান্ট ওয়াটার পিউরিফায়ার কিউ৮০০ পানি গরম করতে মাত্র ১ সেকেন্ড সময় নেয়। চীনের বাইরে এই পিউরিফায়ার বাজারজাত করা হচ্ছে না আপাতত। তবে ভবিষ্যতের ওয়াটার পিউরিফায়ার কেমন হবে, তার একটি ধারণা দিয়েছে শাওমি।