আলবার্ট হলের আলো-আঁধারি সিঁড়ি পেরিয়ে বন্ধু অমৃত দত্তের সঙ্গে সোমেন উঠে এলেন তিন তলার স্টুডিওতে। সোমেন ঢাকার ছেলে, বয়স মাত্র ১৮ বছর। এই বয়সেই গল্প লিখে বেশ নাম করেছেন। এই তো গত বছর ‘সাপ্তাহিক দেশ’ পত্রিকায় একটা গল্প ছাপা হয়েছে—‘শিশু তপন’। সেবার বড়দিনের ছুটিতে বেড়াতে এসেছেন কলকাতা। কলেজ স্ট্রিটের র্যালফ ফক্সের একটা বই খুঁজছিলেন। স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলার প্রস্তাব দিলেন অমৃত। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের মুখে অমৃত অনেক শুনেছেন এই স্টুডিওর কথা, এর ফটোগ্রাফারের কথা। প্রস্তাবে সাড়া দিলেন সোমেন। ফটোগ্রাফারের নির্দেশমতো পরনের রংজ্বলা ধূসর উলের চাদরটা সরিয়ে রাখলেন সোমেন; বেত বোনা চেয়ারটার পেছন ভাগে হাত রেখে বসলেন। ওদিকে কালো কাপড়ে মাথা ঢেকে তেপায়া ক্যামেরার পেছন–ভাগে দাঁড়ালেন ফটোগ্রাফার। লেন্সের খাপটা খুলে নিয়ে আওড়ালেন ‘ওয়ান, টু, থ্রি…’। ১৯৩৮ সালে ডিসেম্বরের এক বিকেলে তোলা হলো সোমেন চন্দের জীবনের একমাত্র ছবি। এর তিন বছর পরই ঢাকার বুকে আততায়ীর আক্রমণে অমিত সম্ভাবনাময় এই সাহিত্যিকের জীবন প্রদীপ নিভে যায়। আঠারো বছরের সোমেনের মুখটি যার ক্যামেরায় অমর হয়ে রইল, তাঁর নাম চারুচন্দ্র গুহ (১৮৮৪–১৯৫৭)। স্টুডিও ব্যবসার প্রাথমিক যুগে যে ক’জন বাঙালি ফটোগ্রাফার দিশারি হয়ে কাজ করেছেন, তাঁদের অন্যতম নাম চারু গুহ। নামটি আজকের ঢাকাবাসীর কাছে নতুন ঠেকলেও বুড়িগঙ্গার ওপারে তেঘরিয়ায় জন্ম নেওয়া চারু গুহর কর্মজীবনের শুরুটা কিন্তু হয়েছিল এই ঢাকাতেই।
ভদ্রলোকের নিজস্ব স্টুডিও ছিল। তবে কিছুদিন পর তিনি স্টুডিও ব্যবসা গুটিয়ে দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এদিকে দীর্ঘদিনের আলাপচারিতায় চারুও ঝুঁকে পড়লেন ছবি তোলায়। ফটোগ্রাফারের ফেলে যাওয়া ব্যবসার ক্যামেরা, আর আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনে নিতে চাইলেন তিনি। টাকা চেয়ে পূর্ব বাংলায় মাকে চিঠি লিখলেন। সংসারের শত অভাব-অভিযোগের মধ্যেও চারুর চাপাচাপিতে শরৎশশী টাকার জোগাড় করলেন। ছবি তোলার কলাকৌশল শিখে ক্যামেরা, আর অন্যান্য যন্ত্রপাতিসহ চারু ফিরে এলেন তেঘরিয়ায়, মায়ের কাছে। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে তো আর স্টুডিও ব্যবসা চালানো সম্ভব নয়। ওদিকে ছোট ভাই পরেশও মেডিকেল স্কুল পাস করে ডাক্তার হয়েছেন। দুই ভাই মিলে বাসা ভাড়া করে মাকে নিয়ে সংসার পাতলেন ঢাকায়। আর সদরঘাটের কাছেই চারু খুললেন তাঁর স্বপ্নের নিজস্ব স্টুডিও।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এত স্বপ্ন আর উদ্যোগ নিয়ে চালু করার পরও চারুর স্টুডিও ব্যবসা লাভের মুখ দেখল না। স্টুডিও নিয়ে চারুর নিজের অতৃপ্তি ছিল। দার্জিলিঙে বিদ্যুতের সুবিধা ছিল, কৃত্রিম আলোকে নিয়ন্ত্রণ করে ফটোতে নানান শৈল্পিক মাত্রা যোগ করা যেত। আলোছায়ার খেলাকে ধারণ করবার সেই সুযোগ ঢাকায় সীমিত। এ সীমাবদ্ধতার সঙ্গে আয়ের বিষয়টিও যোগ হলো।
কলকাতায় পৌঁছে প্রথম শুরু করলেন ঘুরে ঘুরে ছবি তোলার কাজ। সারা দিন একটা ভারী ক্যামেরা নিয়ে ট্রামে চেপে আউটডোরে ছবি তুলতেন। বিকেলে ধর্মতলার এক স্টুডিওর ডার্ক রুমে বসে সেসব ডেভেলপ করতেন। নিজের সঞ্চয়ে একসময় হ্যারিসন রোডের (বর্তমান মহাত্মা গান্ধী রোড) যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, সেখানে নতুন করে স্টুডিও ব্যবসা চালু করেন। এবার প্রথমেই করলেন বিদ্যুতের ব্যবস্থা, হাজার ওয়াটের এক বাল্ব জুড়ে দিলেন স্টুডিওতে। স্টুডিওর নামও রাখলেন ‘ইলেক্ট্রো ফটো স্টুডিও’। হ্যারিসন রোডে ছবি তুলবার মানুষ পেতে চারুকে বেগ পেতে হলো না।
এক বিকেলে ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন এলেন, সঙ্গে কবি সুফিয়া এন হোসেন (পরবর্তীকালে বেগম সুফিয়া কামাল)। সেটা ১৯২৯ সালের কথা। নাসিরউদ্দীন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ‘সওগাত’–এর একটি নারী সংখ্যা প্রকাশ করবেন, যেখানে লেখিকাদের ছবিসহ লেখা থাকবে। সেকালে মুসলিম নারীদের ছবি তোলার উদাহরণ বিরল। কবি সুফিয়া কামাল কখনো ক্যামেরার সামনে দাঁড়াননি। চারুও কোনো মুসলিম নারীর ছবি তোলেননি। এর সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে নাসিরুদ্দীনকে সতর্কও করেন চারু। কিন্তু নাসিরুদ্দীন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। প্রথম এক মুসলিম নারী কবির ছবি তোলার কোনো পারিশ্রমিক নিলেন না চারু। ছবিগুলো সযত্নে পাঠিয়ে দিলেন ‘সওগাত’ অফিসে। চারুর তোলা সেই ছবিসহ প্রথম নারী সংখ্যা ‘সওগাত’ প্রকাশ পায় সে বছরের সেপ্টেম্বরে। এ সংখ্যা প্রকাশের পর অনেক মুসলিম লেখিকা তাঁদের ছবি পত্রিকায় ছাপাতে সম্মত হন।
চারু গুহর জীবনাবসান হয় ১৯৫৭ সালে। মৃত্যুর পর বড় ছেলে চিত্তরঞ্জন চার দশক ধরে চালিয়ে নেন ছবি তোলার ব্যবসা। স্টুডিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার বেশ অনেক কাল পর চারুর উত্তরসূরিরা সেখানে গড়ে তোলেন এক প্রদর্শনীশালা। সাধারণ পেশাজীবী মানুষকে ছবি তোলায় আকৃষ্ট করার জন্য এক কালে চারু আলবার্ট হলের দেয়ালে জুড়ে দিয়েছিলেন, ‘Your mother, wife and Children-keep them nearby photograph’, ‘If you want a record, have it photographed’, ‘If you have beauty I will take it, if you have none, come, I will make it. ’ ইত্যাদি কত কত বিজ্ঞাপন! রং চটে যাওয়া মলিন সেসব বিজ্ঞাপনের কিছু আজও টিকে আছে। আর স্টুডিওতে ঢুকবার মুখে চারুর তোলা কিছু ছবি পিন দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। বড় বড় স্বপ্নভরা চোখ নিয়ে সোমেন চন্দ সেখানে দিব্যি তাকিয়ে আছেন, ঠিক যেমনটি ছিলেন চারুর লেন্সের সামনে, আজ থেকে আশি বছর আগে।
সহায়ক সূত্র:
১. চারু গুহ: জীবন ও আলোকচিত্র, বই-চিত্র, ২০০৭
২. বেগম, ৫০ বর্ষ পূর্তি সংখ্যা, ২০০০
৩. পুরান ঢাকার সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ, অনুপম হায়াৎ, বাংলা একাডেমি, ২০০১
তারেক আজিজ: অধ্যাপক, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়