হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-বঞ্চনার দীর্ঘ পথ পেরিয়ে মানুষ যখন নতুন বছরে প্রবেশ করে, তখন অনুভূতির ভেতর এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব কাজ করে। একদিকে নতুন সূচনার আনন্দ, অন্যদিকে জীবন থেকে আরেকটি বছর অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার বেদনাবোধ। প্রতিটি অতিবাহিত বছর মানে নির্ধারিত হায়াতের একটি অংশ কমে যাওয়া। নতুন বছর আগমনের এ সন্ধিক্ষণ মুমিনের জন্য ত্মসমালোচনা ও ভবিষ্যৎ-পরিকল্পনার সময়।
ইসলামের দৃষ্টিতে একজন ইমানদারের জন্য নতুন বছরের করণীয় মৌলিকভাবে দুটি—এক. অতীত জীবনের হিসাব নেওয়া। দুই. আগামীর পথচলা সুপরিকল্পিত করা।
মানুষের জীবন আল্লাহ তাআলার দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ আমানত। এই আমানতের প্রতিটি মুহূর্ত কীভাবে ব্যয় করা হলো, আখিরাতে তার পূর্ণাঙ্গ জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ তাআলার কোনো আদেশ অমান্য করা কিংবা সময়কে অলসতায় নষ্ট করা এই আমানতের খেয়ানতের শামিল। খেয়ানতের পরিণতি যে ভয়াবহ, তা কোরআন-হাদিসে বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত কোনো মানুষ আল্লাহর দরবার থেকে এক পা-ও নড়তে পারবে না। এক. তার জীবন সম্পর্কে, সে কীভাবে তা অতিবাহিত করেছে। দুই. তার যৌবনকাল সম্পর্কে, সে কোন কাজে তা ব্যয় করেছে। তিন. তার সম্পদ সম্পর্কে, কীভাবে সে তা উপার্জন করেছে। চার. এবং উপার্জিত সম্পদ কোথায় ব্যয় করেছে। পাঁচ. সে যে জ্ঞান অর্জন করেছিল, সে অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে।’ (জামে তিরমিজি: ২৪১৬)। যেহেতু হিসাব অবশ্যম্ভাবী, তাই পরকালের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর আগে নিজের হিসাব নিজে করে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
নতুন বছরের শুরুতে মুমিনের প্রথম কাজ হওয়া উচিত গত বছরের জীবনচিত্র পর্যালোচনা করা। যদি দেখা যায়, সময়ের একটি বড় অংশ আল্লাহর আনুগত্যে ব্যয় হয়েছে, তাহলে তার জন্য কৃতজ্ঞতা আদায় করা জরুরি। কারণ কৃতজ্ঞতা নিয়ামত বৃদ্ধির অন্যতম চাবিকাঠি। আর যদি গুনাহ, অবহেলা ও ত্রুটির হিসাব চোখে পড়ে, তবে বিলম্ব না করে ক্ষমা প্রার্থনা ও খাঁটি তওবা করে নেকির পথে ফিরে আসাই ইমানদারের কাজ।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আন্তরিকভাবে আল্লাহর কাছে তওবা করো। আশা করা যায়, তোমাদের রব তোমাদের পাপ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদের প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতে, যার তলদেশে নহর প্রবাহিত।’ (সুরা তাহরিম: ৮)
তওবার পাশাপাশি নেক আমলে আত্মনিয়োগ করাও জরুরি। কেননা সৎকর্ম পাপের কালিমা মুছে দেয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই পুণ্যরাজি পাপরাশিকে মিটিয়ে দেয়। যারা উপদেশ মানে, এটা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ।’ (সুরা হুদ: ১১৪)
নতুন বছরে মুমিনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো আগামীর জন্য সুদৃঢ় সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা। যাতে অবশিষ্ট জীবন আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে ব্যয় হয়। অহেতুক ব্যস্ততা, অর্থহীন বিনোদন কিংবা অলসতায় যেন একটি মুহূর্তও নষ্ট না হয়।
এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হবে নিজের নফসকে সংযত রাখা এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। এ প্রসঙ্গে শাদ্দাদ ইবনে আউস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘বুদ্ধিমান হলো সে, যে নিজের কুপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য আমল করে। আর অক্ষম হলো সে, যে নিজের কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে চলে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমার আশা পোষণ করে।’ (জামে তিরমিজি: ২৪৫৯)
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুস সুন্নাহ রাজাবাড়ী, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।