সময়ের আবর্তনে আমাদের দোরগোড়ায় আবারও হাজির হয়েছে মহিমান্বিত আরবি মাস—রজব। হিজরি পঞ্জিকাবর্ষের সপ্তম এই মাসটি মুমিনের জীবনে এক পরম পুণ্যের বার্তা নিয়ে আসে। পরকালীন পাথেয় ও সওয়াব হাসিলের তরে রজব মাস এক বিশাল সুযোগের মোহনা, যা বিশেষভাবে সিয়াম সাধনার মাস রমজানের অগ্রিম আগমনী বার্তা ঘোষণা করে। আধ্যাত্মিক পরিভাষায় এই রজব যেন আমলের বসন্ত; যে বসন্তের স্নিগ্ধ হাওয়ায় মুমিন হৃদয় হয়ে ওঠে সবুজ ও সজীব। জান্নাতি খুশবুর ঘ্রাণে মাতোয়ারা মুমিনের মন দুলতে থাকে রবের একান্ত প্রেমে। রজব যেন দিগন্তের আকাশে ভেসে বেড়ানো রহমতের মেঘমালা, যা আল্লাহর তৃষ্ণার্ত বান্দার হৃদয়কে মহান প্রভুর করুণার সুশীতল ছায়ায় পরম মমতায় ঢেকে দেয়। এভাবে প্রতিটি মুমিন হৃদয়ে রজব মাস হয়ে ওঠে ইবাদত ও আনুগত্যের এক অনন্য ঋতু।
রজব মাসের মাহাত্ম্য
রজব মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য। এর প্রধান কারণ হলো, এই মাসকে মহান আল্লাহ এবং তাঁর প্রিয় রাসুল (সা.) বিশেষভাবে সম্মানিত বলে ঘোষণা করেছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ‘আশহুরুল হুরুম’ বা সম্মানিত যে চারটি মাসের কথা উল্লেখ করেছেন, রজব তার মধ্যে অন্যতম। ইরশাদ হয়েছে—‘নিশ্চয় আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই মহান আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা বারোটি। এর মধ্যে চার মাস সম্মানিত। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করে নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত কোরো না।’ (সুরা তাওবা: ৩৬)
হাদিস শরিফেও এই সম্মানিত মাসগুলোর বিবরণ চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে। হজরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন—‘বছর হচ্ছে বারো মাস। এর মধ্যে চার মাস হারাম বা নিষিদ্ধ। তিনটি ধারাবাহিক: জিলকদ, জিলহজ ও মহররম; আর অন্যটি হলো (মুদার গোত্রের) রজব মাস, যা জুমাদাল উখরা ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী সময়ে অবস্থিত।’ (সহিহ বুখারি: ৪৬৬২, সহিহ মুসলিম: ১৬৭৯)
রজব: রমজানের প্রস্তুতির সুবর্ণ সময়
রজব মাস থেকেই মূলত আমাদের কাঙ্ক্ষিত রমজানের প্রস্তুতি শুরু হওয়া উচিত। কেননা রজবের পরেই আসবে শাবান, আর এই দুই মাসের প্রহরগুলো গড়ালেই শুরু হবে সিয়াম সাধনার পবিত্র মাস—রমজান। রমজানের সেই সুকঠিন ও মহান সাধনার গুরুত্ব বিবেচনা করে দুই মাস আগে রজব থেকেই এর মানসিক ও আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি গ্রহণের কথা হাদিসে গুরুত্বের সঙ্গে বলা হয়েছে। তাই তো রজব মাসের চাঁদ উদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাসুলুল্লাহ (সা.) এই দোয়াটি পাঠ করতেন—‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবা ওয়া শাবানা ওয়া বাল্লিগনা রামাদান।’ অর্থাৎ: ‘হে আল্লাহ, রজব ও শাবান মাসে আমাদের জন্য বরকত দান করুন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত জীবিত রাখুন (রমজানে পৌঁছিয়ে দিন)।’ (মুসনাদে আহমদ: ২৩৪৬)
রমজানের পূর্ণ বরকত পেতে হলে প্রয়োজন শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক সুপরিকল্পিত প্রস্তুতি। রমজানে যেহেতু ইবাদত, আহার ও নিদ্রার সময়সূচিতে আমূল পরিবর্তন আসে, তাই আমাদের উচিত এ রজব মাস থেকেই নফল রোজা রাখার মাধ্যমে নিজেকে অভ্যস্ত করে তোলা। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, নবীজি (সা.) রমজান ছাড়া সবচেয়ে বেশি নফল রোজা রাখতেন শাবান মাসে, আর এর প্রস্তুতি শুরু হতো রজব থেকে। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, ‘রজব মাস এলে আমরা নবীজি (সা.)-এর বিশেষ আমল ও ইবাদত দেখে তা অনুভব করতে পারতাম।’ (সহিহ মুসলিম: ১৪৪৩)
তিলাওয়াত ও আধ্যাত্মিক অনুশীলন
কেবল রোজা নয়, বরং পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত ও এর চর্চায় মনোযোগী হওয়া রজব মাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কোরআন তিলাওয়াত শেখা, অশুদ্ধি সংশোধন করা, নামাজের প্রয়োজনীয় সুরা-কিরাত এবং দোয়া-দরুদগুলো ভালোভাবে আয়ত্ত করা এ সময়ে অত্যন্ত জরুরি। এতে করে রমজানের পবিত্র দিনগুলোতে আমল করা অনেক সহজ ও সাবলীল হয়ে ওঠে। বিখ্যাত তাফসিরগ্রন্থগুলোতে এসেছে যে এই সম্মানিত মাসগুলোর বিশেষত্ব হলো—এতে অধিক ইবাদত ও নেক আমলের অনুশীলন করলে বছরের বাকি মাসগুলোতেও ইবাদতের প্রতি একনিষ্ঠতা বজায় রাখা সহজ হয়ে যায়। (আহকামুল কোরআন: খণ্ড ২, পৃ. ১১১)
সতর্কতা ও বিশেষ আমল
আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে আইয়ামে বিজ (চাঁদের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ) এবং প্রতি সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবারের নফল রোজা ব্যতীত রজব মাসে আলাদাভাবে বিশেষ কোনো তারিখ বা দিনে সুনির্দিষ্ট রোজার আমল নেই। তবে রমজানের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে আমরা যেকোনো নিষিদ্ধ সময় ব্যতীত নফল রোজা রাখতে পারি। যেহেতু রজব ‘আশহুরুল হুরুম’ বা সম্মানিত মাসের অন্তর্ভুক্ত, তাই এ সময়ে সম্পাদিত নেক আমলের বিপরীতে মহান আল্লাহর কাছে অধিক সওয়াবের আশা করা যায়। মুস্তাহাব আমল হিসেবে এই হারাম মাসগুলোতে রোজা রাখার সপক্ষে নবীজি (সা.)-এর একটি হাদিস পাওয়া যায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সম্মানিত মাসগুলোতে রোজা রাখো এবং রোজা ভঙ্গও কোরো (অর্থাৎ বিরতি দিয়ে দিয়ে নফল রোজা রাখো)।’ (সুনানে আবু দাউদ: ২৪২৪)
হাদিসের বর্ণনায় রজবের আরও একটি শ্রেষ্ঠ আমলের কথা এসেছে—তা হলো দোয়া। রাসুল (সা.)-এর ভাষ্য অনুযায়ী ‘দোয়া হলো ইবাদতের মগজ’। তাই আমলের এই বসন্তলগ্নে আমাদের উচিত অধিক পরিমাণে কায়মনোবাক্যে প্রভুর দরবারে রোনাজারি করা।
লেখক: খতিব, সোনার বাংলা জামে মসজিদ, কুষ্টিয়া