হোম > বিশ্ব > মধ্যপ্রাচ্য

ইসরায়েলি আগ্রাসনে দীর্ঘমেয়াদি জিনগত ক্ষতির মুখে গাজার শিশুরা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­

গাজার দেইর এল বালাহে ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত এক আবাসিক এলাকায় কতিপয় বিষণ্ন শিশু। ছবি: এএফপি

ভাতই একমাত্র ন্যূনতম পুষ্টিকর খাবার, যা দিয়ে মেয়ে রোয়ানকে বাঁচিয়ে রাখছেন মোহাম্মদ আলদ্রেইনি। ২২ মাস বয়সী ফিলিস্তিনি শিশুটি জন্মের পর থেকে কখনো মায়ের দুধের স্বাদ পায়নি। তার জন্ম ২০২৩ সালের নভেম্বরে—গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা শুরু হওয়ার এক মাস পর।

রোয়ানের মা চার সন্তানের দেখাশোনা করছেন। বিষণ্নতায় ভুগছেন তিনি। অবরোধ আর লাগাতার বোমাবর্ষণের মানসিক আঘাতে তাঁর বুকে দুধ বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবারটি প্রথমে উত্তর গাজার বাইত লাহিয়া থেকে পালিয়ে যায় গাজা সিটিতে। পরে আশ্রয় নেয় খান ইউনিসে।

আলদ্রেইনি বলেন, ‘এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমার স্ত্রীর পিটিএসডি ধরা পড়েছে।’ বিষণ্ন গলায় তিনি যখন এসব বলছিলেন, তখন তাঁর স্ত্রী একটি ছোট হাঁড়িতে চাল সিদ্ধ করে মেয়ের জন্য দুধ ছাড়া পায়েস রান্না করছিলেন।

রোয়ান উত্তরাধিকার সূত্রে মায়ের দুর্বলতা পেয়েছে। সে হাঁটতে পারে না, কথা বলতে পারে খুব সামান্য। দুর্বল রোগ প্রতিরোধক্ষমতা, হৃদ্‌রোগ আর মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে। ওজন ক্রমেই কমছে। এখন ওজন মাত্র ৭ কেজি। তার বাবার ভাষায়, ইসরায়েলের চাপানো ‘পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষে’ তার শরীর ভেঙে পড়ছে। আলদ্রেইনির বিশ্বাস, যথেষ্ট খাবার পেলে আর যুদ্ধ থামলে রোয়ান বাঁচতে পারে।

তবে জিন গবেষকেরা সতর্ক করেছেন, বেঁচে গেলেও রোয়ানের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যঝুঁকি গুরুতর। এমনকি এই প্রভাব তার ভবিষ্যৎ সন্তানদের ওপরও পড়তে পারে। গত দুই দশকের নানা গবেষণা বলছে—ক্ষুধা, যুদ্ধ আর গণহত্যার মতো ঘটনার প্রভাব মানুষের জিনে দীর্ঘস্থায়ী দাগ ফেলে। ক্ষুধা বা মানসিক আঘাতে ডিএনএ বদলায় না। তবে এতে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে, যা জিনের প্রকাশে প্রভাব ফেলে। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় এপিজেনেটিকস। এর মাধ্যমে যুদ্ধের প্রভাব প্রজন্মের পর প্রজন্মে পৌঁছে যায়।

নাৎসি দখলদারিত্বের সময় ১৯৪৪-৪৫ সালে নেদারল্যান্ডসের পশ্চিমাঞ্চলে খাবার সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। বহু বছর পর গবেষকেরা দেখেন, সেই সময় গর্ভবতী মায়েদের সন্তানদের মধ্যে গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী অধ্যাপক টেসা রোজবুম বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে, মায়ের দেহের স্ট্রেস হরমোন সন্তানের শরীর ও মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনিরাপদ, চাপপূর্ণ ও অপুষ্টির পরিবেশে থাকা বাবাদেরও প্রভাবও সন্তানের ওপর পড়ে।’

২০১৫ সালে গবেষক র‍্যাচেল ইয়েহুদা ৩২ জন হলোকাস্ট থেকে বেঁচে ফেরা ব্যক্তি ও তাঁদের সন্তানদের নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন। সেখানে স্পষ্ট প্রমাণ মেলে যে, বাবা-মায়ের অভিজ্ঞতাই সন্তানের জিনে চাপ ফেলেছে।

গাজায় এখনো এপিজেনেটিক পরিবর্তন নিয়ে সরাসরি গবেষণা হয়নি। তবে নেদারল্যান্ডস, চীন আর হলোকাস্টের অভিজ্ঞতা থেকে বিজ্ঞানীরা তুলনা করছেন। রোজবুম বলেন, ‘গাজার শিশুদের ওপর বর্তমান পরিস্থিতির প্রভাব এত ভয়াবহ যে, তা তাদের জীবনভর ক্ষতি করবে—এমনকি যুদ্ধ শেষ হলেও।’

রুয়ান্ডা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. লিয়ন মুটেসা বলেন, গাজায় আমরা ইতিমধ্যে কিছু উপসর্গ দেখতে পাচ্ছি—ভয়, মানসিক চাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল। এগুলো এপিজেনেটিক পরিবর্তনের প্রাথমিক ইঙ্গিত, যেটা আমরা রুয়ান্ডায়ও দেখেছিলাম। তিনি ব্যাখ্যা করেন, ‘রুয়ান্ডায় দেখা গেছে—গণহত্যার সময় জন্ম নেওয়া শিশুদের ওপর মায়েদের ট্রমা গভীর প্রভাব ফেলে। মানসিক ব্যাধি, বিষণ্নতা, বাইপোলার, হ্যালুসিনেশনসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। তাঁর মতে, যুদ্ধক্ষেত্রের প্রভাব আরও ভয়ংকর। অনাহার, বাস্তুচ্যুতি, সহিংসতা—সব মিলিয়ে গাজায় দ্বিগুণ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’

ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের হিসাব অনুযায়ী, গত দুই বছরে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ২০ হাজার শিশু নিহত হয়েছে। ইউনিসেফ বলছে, নিহত বা আহত শিশুর সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। শুধু আগস্ট মাসেই ১২ হাজার ৮০০ শিশুকে মারাত্মক অপুষ্টিতে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করেছে জাতিসংঘ। তারা বলছে, গাজায় দুর্ভিক্ষ ‘অস্বীকার করার উপায় নেই’।

উইসকনসিন–ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের এপিজেনেটিকস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হাসান খাতিব সতর্ক করে বলেন, ‘গাজায় ভয়াবহ জেনেটিক বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।’ তাঁর ভাষায়, গর্ভবতী নারী ও কিশোরদের জন্য বিশেষ ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তিনি সাম্প্রতিক একটি গবেষণার উদাহরণ টেনে বলেন, বাবার খাদ্যাভ্যাস ভেড়ার পরবর্তী দুই প্রজন্মের স্বাস্থ্য ও রোগ প্রবণতা প্রভাবিত করেছে। তাঁর মতে, গাজায় জটিল সব পরিস্থিতি মানুষের ওপর নেতিবাচক চাপ ফেলছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও ভয়াবহ বিপর্যয় বয়ে আনবে।

রোয়ানের শারীরিক অবস্থা পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, তাঁর গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়েছে, যা অতীত গবেষণার ফলের সঙ্গে মিলে যায়। রোজবুম বলেন, শিশুটি প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাচ্ছে না। এতে তার বিপাকক্রিয়া স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস বা হৃদ্‌রোগ হতে পারে। মুটেসার মতে, যুদ্ধ আর অনাহার রোয়ানের জিনকে বদলে দিচ্ছে। এর প্রভাব পড়বে তার পরবর্তী প্রজন্মেও।

গবেষকেরা একটি স্পষ্ট সমাধানের কথাই বলছেন—যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। মুটেসা বলেন, রুয়ান্ডায় দেখেছি, সহিংসতা শেষ হওয়ার পর যখন সহায়তা দেওয়া হয়েছিল, তখন কিছু মানুষের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, জীবনধারা এবং পরিবেশও জিনের প্রকাশে প্রভাব ফেলে। নিরাপদ পরিবেশ, খাবার, চিকিৎসা আর সামাজিক স্থিতিশীলতা ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে।

রোজবুম বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। গাজায় শিশুদের কষ্ট শুধু আজকের জন্য নয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহন করবে এর বোঝা। যদিও ইতিমধ্যে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সঠিক সহায়তা পেলে আরও বড় বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব।

আলদ্রেইনি বলেন, ‘আমি দেখি আমার সন্তানেরা দিনে দিনে দুর্বল হচ্ছে। আমি আর আমার স্ত্রী ডায়াবেটিস আর উচ্চ রক্তচাপে ভুগছি। তবু আমি স্বপ্ন দেখি—একদিন এই গণহত্যা শেষ হবে। আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরব—আর সব মানুষের মতো।’

তথ্যসূত্র: মিডল ইস্ট আই

গাজায় হামলা চালিয়ে হামাসের শীর্ষ কমান্ডারকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের

সিরিয়ায় আইএসের হামলায় দুই মার্কিন সেনা এবং এক দোভাষী নিহত

এবার ডিজেলবাহী ট্যাংকার জব্দ করল ইরান, বাংলাদেশিসহ ১৮ ক্রু আটক

ইরানে দুইবার সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে ওয়াশিংটন: মার্কিন দূত

জানুয়ারিতেই হতে পারে গাজায় আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েন, সেনা প্রস্তুত করছে ইন্দোনেশিয়া

তীব্র শীতে গাজায় প্রাণ সংহারকারীর ভূমিকায় ‘বায়রন’, নিহত অন্তত ১৪

ইরানে নোবেলজয়ী নার্গিস মোহাম্মাদি গ্রেপ্তার

এবার গাজাবাসীর নতুন হুমকি ঘূর্ণিঝড় বায়রন, ঝুঁকিতে সাড়ে ৮ লাখ মানুষ

ইসরায়েলি বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের শর্তে গাজায় এক দশকের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব হামাসের

সিরিয়ায় এক বছরে ৬০০ হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল, দখল করেছে ভূমি