ইরানে স্বামীকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক বালিকাবধূর প্রাণ বাঁচাতে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ১০০ কোটি তুমান (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা) জোগাড় করতে হবে। নইলে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে ২৫ বছর বয়সী গোলি কোহকান নামের এই নারী সাত বছর ধরে উত্তর ইরানের গোরগান কেন্দ্রীয় কারাগারে মৃত্যুদণ্ডের অপেক্ষায়। ২০১৮ সালের মে মাসে ১৮ বছর বয়সে স্বামীকে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। পরে আদালত তাঁকে ‘কিসাস’ (প্রতিশোধমূলক শাস্তি) আইনে মৃত্যুদণ্ড দেন।
গোলি কোহকান ইরানের অবহেলিত জাতিগোষ্ঠী বেলুচ সম্প্রদায়ের সদস্য। দেশটির মোট জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ এই সম্প্রদায়ের। গোলি পরিচয়হীন একজন নারী। মাত্র ১২ বছর বয়সে নিজের চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। এরপর ১৩ বছর বয়সে তিনি গর্ভবতী হন এবং এক ছেলের জন্ম দেন।
২০১৮ সালের মে মাসে ঘটনার দিন গোলি দেখতে পান, তাঁর স্বামী পাঁচ বছরের ছেলেকে মারধর করছেন। তখন তিনি চাচাতো ভাইকে ফোন করে সাহায্য চান। তাঁর চাচাতো ভাই এসে পৌঁছালে উভয়ের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়। হাতাহাতির একপর্যায়ে গোলির স্বামী নিহত হন। পরে গোলি নিজেই অ্যাম্বুলেন্স ডাকেন ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানান।
স্থানীয় পুলিশ এসে আইনজীবী ছাড়াই গোলিকে জোর করে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করে। নিরক্ষর গোলি জেরার চাপে জবানবন্দিতে সই করে হত্যার দায় স্বীকার করেন, যা পরে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের ভিত্তি হয়।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, গোলির মামলা ইরানে নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতীক। দেশটিতে বাল্যবিবাহ বৈধ ও পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে আইনি সুরক্ষা নেই বললেই চলে।
নরওয়েভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ইরান হিউম্যান রাইটসের (আইএইচআর) পরিচালক মাহমুদ আমিরি-মোগাদ্দাম বলেন, গোলি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর একজন দরিদ্র নারী। সমাজের সবচেয়ে দুর্বল অংশের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। তাঁর শাস্তি ইরানি কর্তৃপক্ষের ভয় সৃষ্টির হাতিয়ার ও বৈষম্যমূলক আইনের বাস্তব উদাহরণ।
আইএইচআর জানিয়েছে, গোলি দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর স্বামী কর্তৃক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। একবার স্বামীর নির্যাতন সইতে না পেরে তিনি বাবার বাড়িতে ফিরে যান। তখন তাঁর বাবা বলেন, ‘আমি মেয়েকে সাদা পোশাকে (বিয়ের সময়) বিদায় দিয়েছি, এখন সে শুধু কাফনের কাপড়েই ফিরতে পারবে।’
ইরানি আইনে হত্যা মামলায় ভুক্তভোগীর পরিবার চাইলে ‘দিয়াহ’ বা রক্তঋণ নিয়ে আসামিকে ক্ষমা করতে পারে। জানা গেছে, কারাগার কর্তৃপক্ষ গোলির স্বামীর পরিবারকে রাজি করিয়েছে। এখন গোলি যদি ১০০ কোটি তুমান পরিশোধ করেন এবং গোরগান শহর ছেড়ে চলে যান, তবে তাঁর সাজা মওকুফ হবে।
তবে শর্ত অনুযায়ী, মুক্তি পেলেও গোলি তাঁর ১১ বছর বয়সী ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারবেন না। ছেলেটিকে বর্তমানে তাঁর দাদা-দাদির কাছে রাখা হয়েছে।
ইরানে নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ব্রামশের (Bramsh) সদস্য জিবা বাক্তিয়ারি বলেন, গোলি কোহকানের ঘটনা নতুন নয়। বেলুচ নারীদের পাশাপাশি ইরানের অধিকাংশ নারীই এমন নির্যাতনের শিকার। তাঁদের কথা কেউ জানে না, কেউ শোনে না। দারিদ্র্যের কারণে পরিবারগুলো মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়। তারপরই তাদের জীবনে নেমে আসে এমন নির্যাতন।