হোম > বিশ্ব > মধ্যপ্রাচ্য

লিবিয়ার গোপন মর্গে দেহটি কি ইমাম মুসা আল-সদরের, ৫০ বছরের রহস্য কি উন্মোচনের পথে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­

ইমাম মুসা আল-সদর ১৯৭৮ সাল থেকে নিখোঁজ। ছবি: বিবিসি

প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে লিবিয়ায় হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া শিয়া ধর্মীয় নেতা ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ইমাম মুসা আল-সদরের রহস্য আজও অমীমাংসিত। তাঁর গায়েব হওয়ার ঘটনায় লেবাননসহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে জন্ম নেয় অসংখ্য জল্পনা-কল্পনা, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা। সম্প্রতি ব্র্যাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানী অধ্যাপক হাসান উগাইল একটি ছবির বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন—লিবিয়ার এক গোপন মর্গে ২০১১ সালে পাওয়া একটি দেহ হয়তো মুসা আল-সদরেরই হতে পারে।

রহস্যের সূচনা

এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে বিবিসি জানিয়েছে, ১৯৭৮ সালের আগস্ট মাসে লেবাননের জনপ্রিয় এই নেতা লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির আমন্ত্রণে ত্রিপোলি সফরে যান। সেই সময় লেবানন গৃহযুদ্ধে জর্জরিত ছিল, দক্ষিণাঞ্চলে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা ইসরায়েলের সঙ্গে লড়াই করছিল। সদর চেয়েছিলেন গাদ্দাফিকে বোঝাতে যেন তিনি ফিলিস্তিনিদের প্রভাবিত করে লেবাননের সাধারণ মানুষকে সংঘাত থেকে রক্ষা করেন।

কিন্তু ৩১ আগস্ট সদরকে শেষবার দেখা গিয়েছিল ত্রিপোলির এক হোটেল থেকে বেরিয়ে যেতে। গাদ্দাফির নিরাপত্তা বাহিনী দাবি করে, তিনি রোমে উড়ে গেছেন। কিন্তু তদন্তে প্রমাণিত হয়—সেই দাবি ছিল মিথ্যা। এরপর থেকেই শুরু হয় এক দীর্ঘ রহস্য, যা আজও শেষ হয়নি।

সদরের জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিক প্রভাব

১৯২৮ সালে ইরানে জন্ম নেওয়া মুসা আল-সদর ১৯৫৯ সালে লেবাননে যান। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি লেবাননের শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে একজন অগ্রগণ্য নেতা হয়ে ওঠেন। ১৯৭৪ সালে তিনি গঠন করেন মুভমেন্ট অব দ্য ডিপ্রাইভড, যা শিয়াদের সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সব ধর্মের গরিব মানুষের জন্য কাজ করত। এমনকি তিনি খ্রিষ্টান গির্জায়ও বক্তব্য রেখেছেন—যাতে বোঝা যায় তিনি কতটা অসাম্প্রদায়িক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির ছিলেন।

সকল ধর্ম বিশ্বাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন ইমাম মুসা আল-সদর। ছবি: বিবিসি

শিয়ারা তাঁকে জীবিত অবস্থাতেই ‘ইমাম’ উপাধি দিয়েছিল, যা অত্যন্ত বিরল সম্মান। তাঁর গায়েব হয়ে যাওয়া শিয়াদের বিশ্বাসে এক গভীর ধর্মীয় প্রতীকী অর্থও পেয়েছে। শিয়া দ্বাদশী মতবাদে ‘গায়েব ইমাম’ নামে একটি ধারণাও রয়েছে। সদরের নিখোঁজ হওয়াও তাঁদের কাছে এক ধরনের আধ্যাত্মিক রহস্য হয়ে উঠেছিল।

২০১১ সালে রহস্যের নতুন অধ্যায়

গাদ্দাফি বিরোধী আরব বসন্তের সময় লিবিয়ায় বিপ্লব শুরু হলে কিছু অজানা তথ্য সামনে আসে। লেবানিজ-সুইডিশ সাংবাদিক কাসেম হামাদে ত্রিপোলির এক গোপন মর্গে প্রবেশের সুযোগ পান। সেখানে প্রায় ১৭টি দেহ সংরক্ষিত ছিল—যার মধ্যে একটির উচ্চতা এবং গড়ন সদরের সঙ্গে মিলে যায়। ছবিতে দেখা যায়, মৃতদেহটির মাথার খুলি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত—যা দেখে অনুমান করা হয়, হয়তো তাকে গুলি করা হয়েছিল।

এক মর্গ কর্মী লেবানিজ-সুইডিশ সাংবাদিক কাসেম হামাদেকে মরদেহটি দেখাচ্ছেন। ছবি: বিবিসি

কাসেম দেহটির ছবি তোলেন এবং কিছু চুল সংগ্রহ করে লেবাননের রাজনৈতিক নেতাদের হাতে দেন ডিএনএ পরীক্ষার জন্য। কিন্তু রহস্যজনকভাবে সেই নমুনাও হারিয়ে যায়।

আধুনিক প্রযুক্তির বিশ্লেষণ

ব্রিটেনের ব্র্যাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাসান উগাইল ও তাঁর দল দেহটির ছবির সঙ্গে মুসা সাদরের জীবদ্দশার একাধিক ছবির তুলনা করেন। তাঁদের তৈরি ‘ডিপ ফেস রিকগনিশন’ অ্যালগরিদম অনুযায়ী, ছবিটির মিল ৬০ শতাংশের বেশি—যা প্রমাণ করে এটি হয়তো সদর অথবা তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের দেহ।

অধ্যাপক উগাইল বলেন, ‘এই ফলাফল উচ্চ সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয় যে, ছবিটি ইমাম মুসা সাদরেরই।’ যদিও নিশ্চিত প্রমাণের জন্য ডিএনএ পরীক্ষা অপরিহার্য।

মরদেহের এই ছবিটির সঙ্গে মুসা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মুখের গড়ন মিলে যায় অনেকটা। ছবি: বিবিসি

সাংবাদিকদের আটক ও ঝুঁকিপূর্ণ অনুসন্ধান

বিবিসি টিম এই অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে লিবিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার হাতে আটক হয়। ছয় দিন কারাগারে অমানবিক অবস্থায় কাটানোর পর তাঁদের মুক্তি দেওয়া হয়। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, গাদ্দাফি যুগের প্রভাবশালীরা এখনো এই রহস্য উন্মোচন হোক তা চান না।

কেন গাদ্দাফি সদরকে হত্যা করতে চাইতেন?

বিভিন্ন বিশ্লেষকের মতে, এর পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। গাদ্দাফি ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের সহায়তা দিচ্ছিলেন, আর সাদর হয়তো তাঁদের লাগাম টানতে চাইছিলেন। ইরানের কট্টরপন্থী বিপ্লবীরা সদরের মধ্যপন্থী অবস্থানকে ভয় পেতেন। তাঁর প্রভাব থাকলে হয়তো ইরানি বিপ্লব ভিন্ন পথে যেতে পারত।

কিছু সূত্র বলছে, তৎকালীন শাহ অব ইরানের কাছে সদর একটি চিঠি লিখেছিলেন। এতে তিনি কট্টরপন্থীদের শক্তি ভাঙতে সহায়তা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই তথ্য প্রকাশ পেয়ে গেলে বিপ্লবীরা ক্ষিপ্ত হয়েছিল।

লেবাননে সাদরের উত্তরাধিকার

আজও লেবাননের শিয়া রাজনীতি সদরের স্মৃতি ঘিরেই আবর্তিত হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত আন্দোলন ‘আমল’ বর্তমানে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। আমলের নেতা ও লেবাননের পার্লামেন্ট স্পিকার নাবিহ বেরি জোর দিয়ে বলেন—সদর জীবিত আছেন এবং লিবিয়ার কারাগারে আটক। যদিও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। প্রতি বছর ৩১ আগস্ট তাঁকে স্মরণ করে শোক পালিত হয়।

১৯৭০-এর দশকে মুসার প্রতিষ্ঠিত আন্দোলন ‘আমল’ এখন একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। ছবি: বিবিসি

রহস্য কি শেষ হবে?

সত্যিই কি ২০১১ সালে পাওয়া দেহটি মুসা আল-সাদরের? ফেসিয়াল রিকগনিশন ফলাফল তাই বলছে। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হয়তো এখনো তা অস্বীকার করা হচ্ছে। সদরের ছেলে সাইয়্যেদ সাদরেদ্দিন সদর বলেছেন—ছবিতে দেখা দেহ তাঁর বাবার নয়। কেউ কেউ এই বক্তব্যটিকেও রাজনৈতিক হিসেবে মনে করছেন।

তবে ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া এই রহস্যের অবসান হবে না। কাসেমের সংগ্রহ করা চুলের নমুনা যদি হারিয়ে না যেত, হয়তো এখনই সত্য জানা যেত।

ইমাম মুসা আল-সদরের নিখোঁজ হওয়া শুধু এক ব্যক্তির অন্তর্ধান নয়—বরং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ইতিহাসে এক বড় মোড়। যদি সত্যিই প্রমাণিত হয় যে, তিনি গাদ্দাফির কারাগারে খুন হয়েছেন, তাহলে তা শুধু তাঁর অনুসারীদের জন্য নয়, বরং সমগ্র অঞ্চলের ইতিহাসে নতুন আলো ফেলবে। আর যদি তিনি এখনো জীবিত থাকেন, তবে সেটি হবে একবিংশ শতকের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বিস্ময়।

একটি ছবির বিশ্লেষণ কি ৫০ বছরের পুরোনো রহস্য সমাধান করবে? উত্তর হয়তো এখনো অধরা। কিন্তু ইমাম সদরের নাম, তাঁর কাজ ও তাঁর রহস্যময় অন্তর্ধান ইতিহাসে চিরকাল এক অমোঘ প্রশ্ন হয়ে থাকবে।

ইসরায়েলের সঙ্গে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে প্রতিরক্ষা জোট শক্তিশালী করছে গ্রিস ও সাইপ্রাস

যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও ইউরোপের সঙ্গে ‘পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে’ আছে ইরান: পেজেশকিয়ান

নামাজরত ফিলিস্তিনির ওপর গাড়ি চালিয়ে দিলেন ইসরায়েলি সেনা

গাজায় ধ্বংসস্তূপের মাঝেই বড়দিনের আনন্দ খুঁজছে ক্ষুদ্র খ্রিষ্টান সম্প্রদায়

শানলিউরফা: নবীদের যে নগরে মিলেছে তিন ধর্মের মানুষ

৭ অক্টোবরের দায় এড়াতে ফন্দি খোঁজার দায়িত্ব দিয়েছিলেন নেতানিয়াহু: সাবেক মুখপাত্র

মসজিদে নববির মুয়াজ্জিন শেখ ফয়সাল নোমান আর নেই

ইসরায়েল আর ‘কখনোই গাজা ত্যাগ করবে না’

তুরস্কে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে লিবিয়ার ‘জাতীয় ঐক্যের সরকারের’ সেনাপ্রধান নিহত

গাজায় ৭৩ দিনে ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ডের শিকার ৪১১ ফিলিস্তিনি, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন ৮৭৫ বার