আরেক দফা অন্ধকার নেমে এসেছে গাজার আকাশে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী অন্তত ৩ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। উপকূলঘেঁষা এই বিধ্বস্ত উপত্যকা দুদিনের টানা বর্ষণে ডুবে আছে কাঁপতে থাকা মানুষের হাহাকারে। টিনের টুকরো, ছেঁড়া ত্রিপল আর বৃষ্টির মুখে করুণভাবে কাঁপতে থাকা তাঁবুগুলো আশ্রয় নয়, বরং শীতল নিষ্ঠুরতার প্রতীক। ইসরায়েলি অবরোধে আটকে থাকা সহায়তা প্রবেশাধিকার সেই তাঁবুগুলোকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, গতকাল রোববার গাজার আল–নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সের একটি জানিয়েছে, দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের পূর্বে ইসরায়েলি হামলায় ৩ জন নিহত হয়েছে। একই দিনে দখলদার বাহিনী গাজা সিটির জাইতুন পাড়া এবং রাফাহর নিকটবর্তী এলাকাগুলোও লক্ষ্য করে।
গাজা সিটি থেকে আল–জাজিরার ইব্রাহিম আল-খালিলি জানান, ইসরায়েলি সেনারা এখনো তথাকথিত ‘হলুদ রেখার’ ভেতরে ঢুকে গাজাবাসীর ওপর আঘাত হানছে। তাঁর ভাষায়, এই সীমার কাছাকাছি বসবাস করা পরিবারগুলোর জীবন ‘মন্দ থেকে আরও মন্দের দিকে’ গড়াচ্ছে। ব্যাপক বৃষ্টি, ভেঙে পড়া বাড়ি, আর সেনাদের উদ্দেশ্যমূলক আতঙ্ক ছড়ানো—সব মিলিয়ে মানুষের রাতদিন কেটে যাচ্ছে শিউরে ওঠা ভয়ের ভেতর।
গাজায় বাস্তুচ্যুতির বিপর্যয় আজ এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) জানিয়েছে—বিগত দুই বছরের নির্বিচার বোমাবর্ষণে যাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে, এমন ১৩ হাজার পরিবার এখন হিমশীতল আবহাওয়ার মুখে উন্মুক্ত। খোলা আকাশ, টিনের পাতা, বৃষ্টিতে চুঁইয়ে পড়া শীত আর ভয়—এই তাদের ভবিষ্যৎ।
জাতিসংঘের তথ্য বলছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজার ৮০ শতাংশের বেশি ভবন ও বাসস্থান ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। তবু ইসরায়েল এখনো ত্রাণবাহী তাঁবু কিংবা মোবাইল হোম প্রবেশে বাধা দিচ্ছে, যদিও যুদ্ধবিরতির উদ্দেশ্যই ছিল সহায়তার প্রবাহ নিশ্চিত করা।
ইউএনআরডব্লিউএ—এর যোগাযোগ পরিচালক তামারা আলরিফাই বলেন, ইসরায়েল ত্রাণের তালিকা থেকে বহু জরুরি সামগ্রী বাদ দিয়ে দিয়েছে, ‘দ্বৈত ব্যবহার’–এর অজুহাতে। তাঁর ভাষায়, ‘ইসরায়েল অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস সরিয়ে দিচ্ছে, বিশেষত শীতের এই দুর্বিষহ সময়ে।’ তিনি আরও জানান, সংস্থাটির মিসর ও জর্ডানে গুদামে রাখা ৬ হাজার ট্রাক সমপরিমাণ ত্রাণ প্রস্তুত আছে, কিন্তু প্রবেশের অনুমতি নেই।
গাজা সিটি থেকে আল–জাজিরার হানি মাহমুদ জানান, টানা দুই দিনের বৃষ্টিতে বাস্তুচ্যুত শিবিরগুলো কাদায় ডুবে গেছে। উঁচু-নিচু জমির ফাঁদে পানি একদিকে ঢুকছে, অন্যদিকে বেরোতে পারছে না। অনেক অঞ্চল পুরোপুরি পানির তলায়। বোমায় ভেঙে পড়া ভবনগুলোতে আশ্রয় নেওয়া মানুষের অবস্থা আরও দুর্দশার—প্রতিটি দেয়াল চুঁইয়ে পড়ছে পানি, আর ভারী বৃষ্টিতে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা ঘনিয়ে উঠেছে। সমুদ্রের ধারে যারা তাঁবু ফেলেছে, তাদের জন্য নতুন বিপদ—জোয়ারের জলে ভেসে যেতে পারে সবকিছু।
গাজার বাস্তুচ্যুত বাসিন্দা আবদুর রহমান আসালিয়াহ বলেন, ‘সব তাঁবু পানিতে ডুবে গেছে। মানুষের মাদুর, খাবার, পানি, কাপড়—একটাও শুকনা নেই। আমরা নতুন তাঁবুর জন্য সাহায্য চাইছি, অন্তত শীত থেকে একটু রক্ষা পেতে।’
তিনি যোগ করেন, জরুরি সহায়তা আনতে এখনো ইসরায়েলি বাধা অটুট। তাঁবু, ওষুধ, চিকিৎসা-সামগ্রী—সবকিছু আনাই এখনো ‘খুব কঠিন’, এবং ইসরায়েলি পক্ষ ‘আরও বেশি প্রশাসনিক জটিলতা’ চাপিয়ে দিচ্ছে।