প্রবল বিতর্ক এবং জাতীয় নিরাপত্তা-সংক্রান্ত উদ্বেগ সত্ত্বেও ব্রিটেন সরকার লন্ডনের কেন্দ্রে চীনের জন্য একটি নতুন বিশাল আয়তনের দূতাবাস ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা অনুমোদন করতে চলেছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নেওয়া না হলেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সরকার যে পরামর্শ পেয়েছে, তাতে এই বিতর্কিত প্রকল্পের সবুজ সংকেত পাওয়ার পথ খুলে গেছে।
‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় এই অনুমোদনের খবরটি প্রথম প্রকাশিত হয়। বেইজিংয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা কতটা বুদ্ধিমানের কাজ, তা নিয়ে জনপরিসরে চলমান বিতর্কের সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে এটি।
এই নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে আবাসনমন্ত্রী স্টিভ রিডের হাতে। স্পর্শকাতরতার কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এমআই ৫ এবং এমআই ৬-সহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে পরামর্শ করা হয়েছে। বারবার স্থগিত হওয়ার পর এই সিদ্ধান্তের সময়সীমা আগামী ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল।
পূর্ব লন্ডনের রয়্যাল মিন্ট কোর্টে প্রস্তাবিত এই দূতাবাসটি হবে ২০ হাজার বর্গমিটার আয়তনের। সে হিসাবে আয়তনের দিক থেকে ইউরোপে মধ্যে কোনো দেশের সবচেয়ে বড় দূতাবাস হবে এটি। উদ্বেগের মূল কারণ হলো, এই স্থানটি সিটি অব লন্ডনের খুবই কাছাকাছি, যেখান দিয়ে বিপুল পরিমাণ স্পর্শকাতর ডেটা বহনকারী ফাইবার অপটিক কেব্ল গেছে। সমালোচকদের মতে, এই অবস্থানটি গুপ্তচরবৃত্তির ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
অন্যদিকে কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছেন যে লন্ডনের বিভিন্ন স্থানে একাধিক দপ্তর রাখার চেয়ে একটি একক স্থানে দূতাবাস নির্মাণ করা হলে তা নজরদারির জন্য বরং সহজ হবে। ব্রিটিশ সরকারের অভ্যন্তরে এমন ধারণাও রয়েছে যে চীনের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষিত এই দূতাবাস নির্মাণে বাধা দিলে কূটনৈতিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
এই প্রত্যাশিত অনুমোদনের তীব্র সমালোচনা করেছেন বিরোধী কনজারভেটিভ পার্টির ছায়া মন্ত্রিসভার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেম প্রীতি প্যাটেল। তিনি প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের বিরুদ্ধে ‘বেপরোয়া ও নীতিহীন’ হওয়ার অভিযোগ এনে সতর্ক করেছেন, এই অনুমোদন ব্রিটেনকে ঝুঁকিতে ফেলবে।
লিবারেল ডেমোক্র্যাট নেতা এড ডেভি এই সিদ্ধান্তকে ‘ভুল’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘যেসব হংকংবাসী চীনের নিপীড়ন থেকে বাঁচতে আমাদের দেশে এসেছেন, সরকার এখন তাঁদের নাকের ডগায় এমন কিছু হতে দিচ্ছে।’
লেবার পার্টি গত বছর সাধারণ নির্বাচনে জেতার পর থেকে বেইজিংয়ের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক উষ্ণ করার চেষ্টা করছে। চ্যান্সেলর র্যাচেল রিভস এবং বাণিজ্যমন্ত্রী পিটার কাইলসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চীনে সফর করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী স্টারমারও সম্ভবত আগামী বছরের প্রথম দিকেই বেইজিং সফরে যাবেন।
জি ২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়ার পথে সাংবাদিকদের কাছে স্টারমার চীনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে বলেন, তাঁর সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ‘একই থাকবে, অর্থাৎ যেখানে পারি সহযোগিতা করব এবং যেখানে অবশ্যই প্রয়োজন সেখানে চ্যালেঞ্জ জানাব, বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে।’
তবে সমালোচকেরা বলছেন, সরকার বেইজিংয়ের হুমকি সম্পর্কে যথেষ্ট কঠোর নয় এবং যুক্তরাজ্যের উচিত আরও বেশি সতর্ক থাকা। ডেম প্রীতি প্যাটেল হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘স্যার কিয়ার স্টারমার এতটাই দুর্বল এবং আমাদের অর্থনীতি এতটাই অনিশ্চিত যে লেবার পার্টি দেশের খরচের চিন্তা না করেই প্রতিটি সুযোগে চীনের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হচ্ছে।’
উল্লেখ্য, গত সেপ্টেম্বরে চীনের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত দুই ব্যক্তির (যাঁদের মধ্যে একজন সাবেক পার্লামেন্টারি গবেষক) মামলাটি বিতর্কিত পরিস্থিতিতে বাতিল হয়ে যায়। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ বলেছিল, চীনকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করার ক্ষেত্রে সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় প্রমাণ পেতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। গত সপ্তাহে এমআই ৫ সংসদ সদস্যদের কাছে সতর্কতা জারি করে জানিয়েছে, তারা চীনা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গুপ্তচরবৃত্তির উল্লেখযোগ্য ঝুঁকির সম্মুখীন।