বিবিসির মহাপরিচালক টিম ডেভি এবং বার্তা বিভাগের প্রধান ডেবোরা টারনেসের পদত্যাগের ঘটনাকে পরিকল্পিত ‘ক্যু’ বা অভ্যুত্থান বলে দাবি করেছেন ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য সান-এর সাবেক সম্পাদক ডেভিড ইয়েল্যান্ড। তিনি বলেছেন, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সুপরিকল্পিত নকশার ফল।
আজ সোমবার বিবিসি রেডিও ৪-এর টুডে অনুষ্ঠানে ইয়েল্যান্ড বলেন, ‘এটা ছিল এক ধরনের অভ্যুত্থান। এর চেয়েও খারাপ বিষয় হলো, এটা ছিল ভেতর থেকে তৈরি ষড়যন্ত্র। বিবিসির ভেতরে, বোর্ডের খুব কাছের— এমনকি বোর্ডের মধ্যেই— কিছু লোক টিম ডেভি ও তাঁর সিনিয়র টিমকে দীর্ঘ সময় ধরে পদ্ধতিগতভাবে দুর্বল করে দিচ্ছিল। গতকাল যা ঘটেছে, তা এক দিনের ঘটনা নয়, এটি বহুদিন ধরে চলছিল।’
বিবিসির পডকাস্ট When It Hits the Fan-এর সহ-উপস্থাপক ইয়েল্যান্ড আরও বলেন, ‘এখানে মূল সমস্যা হলো— শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা। আমি চেয়ারম্যান সামির শাহকে ব্যক্তিগতভাবে দোষ দিচ্ছি না, তবে যে কোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব হলো তাঁর প্রধান নির্বাহীকে (সিইও) দায়িত্বে রাখা বা সরানো। কিন্তু এখানে টিম ডেভিকে বরখাস্ত করা হয়নি— তিনি নিজেই চলে গেছেন। সেটিই প্রকৃতপক্ষে— এটাই সুশাসনের ব্যর্থতা।’
গতকাল রোববারের ওই পদত্যাগের পেছনে যুক্তরাজ্যের ডানপন্থী মহল ও হোয়াইট হাউসের একের পর এক সমালোচনা ভূমিকা রেখেছে। দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রকাশিত একটি ফাঁস হওয়া প্রতিবেদনে এই বিতর্কের সূত্রপাত হয়।
সেখানে বলা হয়, প্যানোরামা অনুষ্ঠানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি ভাষণের সম্পাদনা নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন গত গ্রীষ্মে দায়িত্ব ছেড়ে যাওয়া বিবিসির সম্পাদকীয় নীতিমালা বিষয়ক স্বতন্ত্র পরামর্শক মাইকেল প্রেসকট। তাঁর দাবি, ওই সম্পাদনা এমনভাবে করা হয়েছিল, যাতে মনে হয় ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ভবনের (ক্যাপিটল হিলে) হামলাকে উসকে দিয়েছিলেন। অথচ ওই ভাষণের দুটি অংশ আসলে এক ঘণ্টার ব্যবধানে দেওয়া হয়েছিল এবং ট্রাম্প একই বক্তৃতায় তাঁর সমর্থকদের ‘শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ’ করার আহ্বানও জানিয়েছিলেন, যা সম্পাদনায় বাদ পড়েছিল।
তবে স্কাই নিউজের সাবেক রাজনীতি বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডাম বোল্টন বলেন, ট্রাম্পের বক্তব্যে বিদ্রোহ উসকে দেওয়ার ইঙ্গিত ছিল— এই সার্বিক ধারণাটি ভুল নয়। দীর্ঘ বক্তৃতা থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ কেটে একত্রে উপস্থাপন করাও সংবাদমাধ্যমের জন্য অস্বাভাবিক কিছু নয়।
তবে ইয়েল্যান্ডের মন্তব্য বিবিসি নিউজের ভেতরে হতাশাজনক পরিবেশকে প্রতিফলিত করে। বিবিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা সত্যিই এক ধরনের অভ্যুত্থান মনে হচ্ছে। এটা বিবিসির রাজনৈতিক শত্রুদের এক পরিকল্পিত প্রচারণার ফল।’
টিম ডেভি জানান, তাঁর পদত্যাগ তাৎক্ষণিক নয়; তিনি সুশৃঙ্খলভাবে ‘দায়িত্ব হস্তান্তরের সময়সূচি’ নিয়ে আগে থেকেই কাজ করছিলেন। অপরদিকে ডেবোরা টারনেস বলেন, প্যানোরামার তথ্যচিত্র সম্পাদনা নিয়ে বিতর্ক এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যা বিবিসির মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠেছিল। এই ক্ষতি এড়াতেই আমার পদত্যাগ, কারণ এই প্রতিষ্ঠানকে আমি গভীরভাবে ভালোবাসি।’
সোমবার বিবিসির সাংবাদিক নিক রবিনসন জানান, প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ে এক ধরনের ‘অচলাবস্থা’ তৈরি হয়েছিল। তিনি বলেন, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা সম্পাদনাগত ভুলের জন্য দুঃখপ্রকাশ করতে চাইলেও রাজনৈতিকভাবে নিয়োজিত পরিচালকেরা এর চেয়েও বেশি কিছু বলতে চেয়েছিলেন— এ নিয়েই টানাপোড়েন তৈরি হয়।
বিবিসির চেয়ারম্যান সামির শাহর আজ যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের সংস্কৃতি, গণমাধ্যম ও ক্রীড়া কমিটিতে উপস্থিত হয়ে প্যানোরামা বিতর্ক বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখপ্রকাশ করার কথা রয়েছে। তিনি কমিটির কাছে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেবেন বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
বিবিসির শীর্ষ দুই কর্মকর্তার পদত্যাগের পর সরকারের ভেটেরান বিষয়কমন্ত্রী লুইস স্যান্ডার-জোনস বলেন, বিবিসি প্রতিষ্ঠানগতভাবে পক্ষপাতদুষ্ট— এমন অভিযোগ সঠিক নয়। স্কাই নিউজকে তিনি বলেন, ‘বিবিসি যে বিপুল পরিসরে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে কাজ করে, তাতে এর সংবাদ এখনো অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য। নানা মতের মানুষ এখনো তাদের তথ্যের প্রধান উৎস হিসেবে বিবিসিকে ব্যবহার করে এবং সেটিই বলে দেয় বিবিসির ওপর আস্থার মাত্রা।’