মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি ভাষণের অংশ জোড়া দিয়ে বানানো প্যানোরমা ভিডিওকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির ভেতরে নানান সংকট তৈরি হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আজ সোমবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপিদের মুখোমুখি (শুনানি) হতে হবে বিবিসির শীর্ষ নির্বাহী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
জানা গেছে, বিবিসির সাবেক সম্পাদকীয় উপদেষ্টা মাইকেল প্রেসকট প্রথমবারের মতো হাউস অব কমন্সের একটি কমিটির সামনে এ বিষয়ে বক্তব্য দেবেন।
এর আগে বিবিসির বেশ কিছু প্রতিবেদনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন মাইকেল প্রেসকট। তিনি ট্রাম্পের ভাষণ নিয়ে তৈরি প্যানোরমা অনুষ্ঠান সম্পাদনার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বিবিসিকে একটি চিঠিও লিখেছিলেন। ওই চিঠি গণমাধ্যমে ফাঁস হওয়ার পর চলতি মাসের শুরুতে বিবিসির মহাপরিচালক ও সংবাদ বিভাগের প্রধান পদত্যাগ করেন।
জানা গেছে, আজকের শুনানিতে উপস্থিত থাকবেন বিবিসির চেয়ারম্যান সামির শাহ, বোর্ড সদস্য স্যার রবি গিব ও ক্যারোলিন থমসন। এ ছাড়া বিবিসির সাবেক সম্পাদকীয় উপদেষ্টা ক্যারোলিন ড্যানিয়েলও আজ গ্রিনিচ মান সময় বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে পার্লামেন্টের কালচার, মিডিয়া অ্যান্ড স্পোর্ট কমিটির সামনে বক্তব্য দেবেন।
ধারণা করা হচ্ছে, এমপিদের কাছ থেকে কড়া প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে বিবিসির শীর্ষ কর্মকর্তাদের। সেখানে তাঁরা বিবিসির বর্তমান অবস্থা, সাংবাদিকতার মান ও পর্দার আড়ালের ঘটনাবলির বর্ণনা দেবেন।
এদিকে, গত শুক্রবার বিবিসির বোর্ড সদস্য সুমিত ব্যানার্জি পদত্যাগ করেছেন। তিনি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ে ‘গভর্ন্যান্স ইস্যু’ বা শাসনব্যবস্থার সমস্যার কথা উল্লেখ করেন।
এ বিষয়ে বিবিসির মিডিয়া সম্পাদক কেটি রাজাল বলেন, সুমিত ব্যানার্জি তাঁর পদত্যাগপত্রে শাসনব্যবস্থার সমস্যার কথা বলে সরাসরি বিবিসির চেয়ারম্যান সামির শাহকে আক্রমণ করেছেন। তাই আজকের শুনানি সামির শাহর জন্য আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।
একই সঙ্গে নজর থাকবে স্যার রবি গিবের দিকে—যিনি বিবিসির সাবেক জ্যেষ্ঠ সম্পাদক এবং ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের যোগাযোগ পরিচালক ছিলেন।
১০ নভেম্বর মাইকেল প্রেসকটের চিঠি প্রকাশ্যে আসার পর সমালোচনার মুখে বিবিসির মহাপরিচালক টিম ডেভি ও নিউজ সিইও ডেবোরা টার্নেস পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
ওই ঘটনার পর পার্লামেন্টারি কমিটিকে পাঠানো এক চিঠিতে চেয়ারম্যান সামির শাহ ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ট্রাম্পের বক্তৃতার দুই অংশ একসঙ্গে জোড়া লাগিয়ে প্যানোরমা অনুষ্ঠানে প্রচার করার বিষয়টিকে ‘ভুল’ বলে স্বীকার করেন।
প্রেসকট তাঁর চিঠিতে আরও কিছু উদ্বেগজনক বিষয়ের কথা বলেন, যার মধ্যে ছিল—ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের কাভারেজে বিবিসি অ্যারাবিক বিভাগের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ।
হাউস অব কমন্সের শুনানি কমিটির চেয়ার কনজারভেটিভ এমপি ক্যারোলিন ডিনেনেজ বলেছেন, টিম ডেভির পদত্যাগ ‘দুঃখজনক’ হলেও বিবিসির প্রতি আস্থা পুনর্গঠনই এখন অগ্রাধিকার। তিনি বলেছেন, বিবিসিকে এখন বেশ কিছু কাজ করতে হবে, যা দেশ-বিদেশে তাদের সুনাম পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে। সাম্প্রতিক সংকট ও ভুল সিদ্ধান্তই বিবিসিকে এমন অবস্থায় নিয়ে গেছে।
বিবিসির এ সংকটকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ ও সংবাদ কাভারেজের মান নিয়েও বিস্তৃত বিতর্ক শুরু হয়েছে। অনেকে অভিযোগ করছেন—প্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাত ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বাড়ছে।
ব্রিটেনের সংস্কৃতিসচিব লিসা ন্যান্ডি বলেছেন, মিডিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব একটি সমস্যা। এ কারণেই বিবিসির নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
স্যার রবি গিবকে ২০২১ সালে কনজারভেটিভ সরকার বিবিসি বোর্ডে নিয়োগ দেয়। তাঁর বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে। তিনি বিবিসি বোর্ডের এডিটরিয়াল গাইডলাইনস অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস কমিটিতে (ইজিএসসি) বসেন—যেখানে শাহ, ডেভি ও থমসনও সদস্য।
পার্লামেন্টারি কমিটি বলেছে, সোমবারের সেশনটিতে ইজিএসসির ‘কার্যপ্রক্রিয়া ও কীভাবে সংস্থাটি তার সংবাদ সম্পাদকীয় মান নিশ্চিত করে’ এ বিষয়ে ফোকাস করা হবে।
এদিকে, গতকাল রোববার আরও এক ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান জানায়, বিবিসি ইজিএসসিকে সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা করছে। বিষয়টি সত্য বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বিবিসি এসব প্রতিবেদনের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি।
এসবের মাঝেই বিবিসি এখন অপেক্ষা করছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন কি না। তিনি প্যানোরমা অনুষ্ঠানের সম্পাদনা নিয়ে অভিযোগ করে এক থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা করার হুমকি দিয়েছেন।