ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত ২৮ দফা শান্তি পরিকল্পনাটি গত সপ্তাহে প্রকাশ্যে আসে। তিনটি সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এই পরিকল্পনার বহু অংশ নেওয়া হয়েছিল রাশিয়ার তৈরি একটি নথি থেকে। রাশিয়া এই নথি গত অক্টোবরে ট্রাম্প প্রশাসনের হাতে তুলে দেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রগুলো বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানায়, রাশিয়া তাদের শর্তাবলি তুলে ধরে ওই প্রস্তাবটি তৈরি করে। পরে সেই নথি যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের হাতে দেয় অক্টোবরের মাঝামাঝি। এর আগে ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে বৈঠক হয়।
কূটনৈতিক পরিভাষায় ‘নন-পেপার’ হিসেবে পরিচিত ওই অনানুষ্ঠানিক নথিতে রাশিয়া তাদের আগের আলোচনাগুলোতে যে ভাষা ও অবস্থান তুলে ধরেছিল তা-ই রাখা হয়। তবে সেখানে এমন কিছু ছাড়ও ছিল, যা ইউক্রেন বহু আগেই প্রত্যাখ্যান করেছে। বিশেষ করে, পূর্বাঞ্চলের বড় একটি অংশ রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দেওয়ার মতো শর্ত।
এটাই প্রথম নিশ্চিত প্রমাণ যে, রুশ নথিটি ২৮ দফার শান্তি পরিকল্পনার মূল ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই নথির অস্তিত্ব গত অক্টোবরে প্রথমে জানায় রয়টার্স। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর কিংবা ওয়াশিংটনে রুশ ও ইউক্রেন দূতাবাস কেউই সাড়া দেয়নি।
হোয়াইট হাউস সরাসরি ওই ‘নন-পেপার’ নিয়ে কিছু বলেনি। তবে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি পরিকল্পনাটির অগ্রগতি নিয়ে আশাবাদী। তিনি লিখেছেন, ‘এই শান্তি পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার আশায় আমি আমার বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফকে মস্কোতে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের নির্দেশ দিয়েছি। একই সময়ে সেনাবাহিনীর সচিব ড্যান ড্রিসকল ইউক্রেন পক্ষের সঙ্গে দেখা করবেন।’
ট্রাম্প প্রশাসন কেন এবং কীভাবে নিজেদের শান্তি পরিকল্পনা তৈরি করতে রাশিয়ার নথির ওপর এতটা নির্ভর করল, তা স্পষ্ট নয়। সূত্র বলছে, নথিটি পর্যালোচনা করা মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েকজন, বিশেষত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও মনে করেছিলেন, মস্কোর দাবিগুলো ইউক্রেন নিশ্চয়ই অগ্রাহ্য করবে।
নথি পাঠানোর পর রুবিও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে কথা বলেন। ওই আলোচনায় নন-পেপারের বিষয়টিও ওঠে বলে সূত্রগুলো জানায়। জেনেভায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রুবিও বলেন, তিনি ‘অনেক নন-পেপার ও এ ধরনের নথি’ পেয়েছেন। তবে বিস্তারিত জানাননি।
গত সপ্তাহে অ্যাক্সিওস নথিটির খবর প্রকাশের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে সংশয় বাড়ছে। অনেকেই পরিকল্পনাটিকে রাশিয়ার বক্তব্যের তালিকা হিসেবে দেখছেন, প্রকৃত কোনো শান্তি উদ্যোগ হিসেবে নয়। তবুও যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। পরিকল্পনায় সই না করলে সামরিক সহায়তা কমিয়ে দেওয়া হতে পারে বলে সতর্ক করেছে ওয়াশিংটন।
জানা গেছে, ২৮ দফার পরিকল্পনার কিছু অংশ তৈরি হয়েছিল গত মাসে মিয়ামিতে ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার, বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং রাশিয়ার একটি সার্বভৌম সম্পদ তহবিলের প্রধান কিরিল দিমিত্রিয়েভের বৈঠকে। ওই বৈঠক সম্পর্কে স্টেট ডিপার্টমেন্ট বা হোয়াইট হাউসের ভেতরের অল্প কয়েকজনই জানতেন।
মঙ্গলবার ব্লুমবার্গ জানায়, উইটকফ ক্রেমলিনের শীর্ষ সহকারী ইউরি উশাকভকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, পুতিন কীভাবে ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলবেন। সংবাদমাধ্যমের হাতে থাকা কল-ট্রান্সক্রিপ্ট অনুযায়ী, উশাকভ ও উইটকফ ১৪ অক্টোবরই সম্ভাব্য ‘২০ দফার পরিকল্পনার’ কথা বলেছিলেন। পরে দিমিত্রিয়েভের সঙ্গে আলোচনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনাটি বিস্তৃত হয়।
হঠাৎ ঘোষিত এই মার্কিন প্রস্তাব ওয়াশিংটন ও ইউরোপের কর্মকর্তাদের বিস্মিত করে। পরবর্তী কয়েক দিনে তিন মহাদেশজুড়ে জোর কূটনীতি শুরু হয়। এবিসি নিউজ জানায়, প্রথমের ২৮ দফার মধ্যে ৯ দফা পরে বাদ দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের উচ্চপর্যায়ের আলোচনার পর।
শনিবার ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান সিনেটরদের একদল জানান, রুবিও নাকি তাদের বলেছেন, এই ২৮ দফা কোনো মার্কিন পরিকল্পনা নয়; বরং রাশিয়ার ইচ্ছার তালিকা। যদিও হোয়াইট হাউস ও পররাষ্ট্র দপ্তর জোর দিয়ে অস্বীকার করেছে যে রুবিও এমন কিছু বলেছিলেন।
পরবর্তী আলোচনায় রুবিওসহ একটি মার্কিন প্রতিনিধিদল ইউরোপীয় ও ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে জেনেভায় বৈঠকে বসে। সেখানে পরিকল্পনার সবচেয়ে রাশিয়াপন্থী অংশগুলো বাদ বা সংশোধন করা হয়। ড্রিসকল বর্তমানে আবুধাবিতে রুশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার জন্য ইউক্রেনের প্রতিনিধিরাও সংযুক্ত আরব আমিরাতে রয়েছে বলে মার্কিন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার ইউক্রেন জানায়, সাম্প্রতিক আলোচনার পর যে সংশোধিত কাঠামো তৈরি হয়েছে, তারা সেটিকে সমর্থন করে। তবে সংবেদনশীল বিষয়গুলো, বিশেষ করে ভূখণ্ড ছাড়ের প্রশ্ন, জেলেনস্কি ও ট্রাম্পের সম্ভাব্য বৈঠকে নিষ্পত্তি করতে হবে।