ইন্দোনেশিয়ার জনপ্রিয় দ্বীপ বালি বহু বছর ধরেই পর্যটকদের কাছে যেন এক স্বপ্নপুরী। রঙিন সৈকত, আধ্যাত্মিক পরিবেশ আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়ানো ঝলমলে ছবিগুলো দ্বীপটিকে ঘিরে তৈরি করেছে এক কল্পলোক। কিন্তু বাস্তবে গিয়ে হতাশ হয়েছেন অনেকেই।
বিবিসি জানিয়েছে, সম্প্রতি বিখ্যাত ইউটিউবার জোয়ে রে বালিতে গিয়ে হতাশার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। বালির বাস্তব চিত্র ইনস্টাগ্রামে দেখা নিখুঁত ছবির মতো ছিল না বলেই তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই দুবাইয়ের পথে উড়াল দেন। তাঁর এমন অভিজ্ঞতা সামাজিক মাধ্যমে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকের ভাষায়, বালি এখন ‘প্রত্যাশা বনাম বাস্তবতা’র এক নিখুঁত উদাহরণ।
বালির ছবি মানেই আমরা দেখি—সোনালি সৈকত, অতিপ্রাকৃতিক পরিবেশে সানসেট রেস্তোরাঁয় রোমান্টিক সব দৃশ্য। কিন্তু সেই রেস্তোরাঁয় পৌঁছাতে হলে পাড়ি দিতে হয় ভাঙাচোরা সিঁড়ি আর স্তূপ করে রাখা আবর্জনা। জলপ্রপাতের সামনে একটি সেলফি তোলার জন্য লাইন ধরে অপেক্ষা করে মানুষ। আবার বাঁশের স্ট্র দিয়ে স্মুদি খাওয়ার পাশেই জ্যামে আটকে থাকা মোটরসাইকেল ধোঁয়া ছড়াচ্ছে।
২০০৬ সালে প্রকাশিত স্মৃতিকথা ও পরবর্তী সময়ে নির্মিত ‘ইট, প্রে, লাভ’ সিনেমার কল্যাণে বালিকে এক আধ্যাত্মিক স্বর্গরাজ্য হিসেবে প্রচার করা হয়। কিন্তু করোনা মহামারির পর উপচে পড়া পর্যটনের কারণে দ্বীপটিতে ভিড়, যানজট ও নির্মাণকাজ বেড়ে গেছে বহুগুণে। এর মধ্যে এ মাসেই ভয়াবহ বন্যায় এক ডজনেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আর লাগামহীন নগরায়ণই এর মূল কারণ।
শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে পশ্চিমা অভিযাত্রীদের কাছে বালি আকর্ষণের কেন্দ্র। হিন্দু সংস্কৃতি, ধানখেত, প্রাচীন গাছ আর পাহাড়কে ঘিরে তৈরি আধ্যাত্মিক আবহ সেখানে টিকে আছে। কিন্তু গত এক দশকে পর্যটকের সংখ্যা—২০১৪ সালে যেখানে ৩৮ লাখ ছিল, ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৩ লাখে। এ বছর পরিসংখ্যানটি ৭০ লাখের ঘরে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আজকের দিনে বালি পরিচিত মূলত সমুদ্র সৈকতের পার্টি ক্লাব, সার্ফ হাউস ও বিলাসবহুল রিসোর্টের জন্য। এর ফলে স্বল্প খরচে বিলাসী জীবনযাপন করতে আসা পশ্চিমা পর্যটকের ভিড়ে দ্বীপের মৌলিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আড়ালে পড়ে যাচ্ছে। ট্রাভেল রাইটার গিজেলা উইলিয়ামসের মতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বালিকে ‘পৃথিবীর এক স্বর্গ’ হিসেবে দেখাচ্ছে।
তবে দ্বীপটিতে ভিড় কম হয়, এমন এলাকাগুলোতে সৌন্দর্য এখনো অক্ষত রয়েছে। দ্বীপের উত্তর অংশের সমুদ্রজীবন, ডলফিন দেখা বা সবুজ পাহাড়ি পথ ভ্রমণ এখনো পর্যটকদের বিমোহিত করে। স্থানীয় কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হোলি মেরি বলেন, ‘শুধু ইনস্টাগ্রামে দেখা জায়গা দেখলে বালির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না।’
অন্যদিকে স্থানীয়রা মনে করেন, পর্যটকদের অভিযোগগুলো একরকম পরিহাস। গবেষক ই মাদে ভিকানন্দার ভাষায়, ‘যখন পর্যটকেরা বলেন বালি ভিড়ে ঠাসা, তখন তারা নিজেরাই সেই ভিড়ের অংশ।’
মাত্র কয়েক বছরেই বালির শান্ত জেলেপল্লী চাঙ্গু ও উলুওয়াতু পর্যটনের কারণে কোলাহলপূর্ণ শহরে রূপ নিয়েছে। এখন সেখানকার সরু গ্রামীণ রাস্তায় ভিড় জমেছে ক্যাফে, জিম আর কো-ওয়ার্কিং স্পেসে।
তবে এর সঙ্গে এসেছে নানা সমস্যা—মাতাল হয়ে স্কুটার চালিয়ে দুর্ঘটনা, পবিত্র স্থানে নগ্ন ছবি, কিংবা বিদেশিদের জড়িয়ে বিবাদ মারামারি। সাম্প্রতিক সময়ে বালিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে পালানো অভিবাসীদের বসতি স্থাপন নিয়েও স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ বেড়েছে।
তারপরও আশার কথা হচ্ছে, স্থানীয় কর্মী ও তরুণ প্রজন্ম পরিবেশ রক্ষায় উদ্যোগ নিয়েছে—বিচ ক্লিন-আপ, প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণ ও পর্যটকদের জন্য আচরণবিধি চালু হয়েছে। সরকারও বুঝতে শুরু করেছে, বালি শুধু বাজার নয়, একটি প্রাকৃতিক সম্পদও।
বালি কিংবা যে কোনো স্থানে ভ্রমণ করা পর্যটকদের মাথায় থাকা উচিত ভ্রমণ বিষয়ক সম্পাদক মারিয়া শোলেনবার্গারের একটি কথা। তিনি বলেন, ‘যেখানেই যাই না কেন, ভ্রমণকারীর দায়িত্ব হলো গন্তব্যের সঙ্গে সম্মানজনক ও দায়িত্বশীলভাবে মেলামেশা করা।’