এই সপ্তাহেই আরও একা হয়ে পড়েছেন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। বিদেশে তাঁর অন্যতম ঘনিষ্ঠ দুই মিত্র শক্তির একটি হন্ডুরাসে এবং আরেকটি সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড দ্য গ্রেনাডাইন্সের জাতীয় নির্বাচনে হেরে গেছে। এই হারের খবর এমন এক সময়ে এল, যখন ক্যারিবিয়ান সাগরের ভেনেজুয়েলা উপকূলে বড় ধরনের নৌ-সমাবেশ ঘটিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে দুই মিত্র হারানোর ঘটনা মাদুরোর ওপর চাপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
মঙ্গলবার (২ নভেম্বর) সিএনএন জানিয়েছে, হন্ডুরাসে বিগত বছরগুলোতে ক্ষমতায় ছিল মাদুরোকে সমর্থন দিয়ে আসা ‘লিবার্টি অ্যান্ড রিফাউন্ডেশন পার্টি’। কিন্তু গত রোববার দেশটিতে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বামপন্থী ওই দলটির প্রার্থী রিক্সি মোনকাদা তৃতীয় হয়েছেন। ফলাফল এখনো স্পষ্ট না হলেও এখন দেশটির দুই ডানপন্থী প্রার্থী সালভাদর নাসরালা ও নাস্রি আসফুরা প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন। শুধু তাই নয়, নির্বাচনের আগে এই দুজনই ভেনেজুয়েলার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার অঙ্গীকার করেছিলেন। এ ছাড়া আসফুরাকে গত সপ্তাহেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থন দিয়েছিলেন।
এদিকে সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড দ্য গ্রেনাডাইন্সে প্রায় ২৫ বছর ক্ষমতায় থাকা মাদুরোর অকৃত্রিম মিত্র প্রধানমন্ত্রী রালফ গনসালভেস পরাজিত হয়েছেন। নতুন সরকার পরিচালনা করবে এবার মধ্য-ডানপন্থী গডউইন ফ্রাইডে। পার্লামেন্টে তিনি ১৫টি আসনের মধ্যে ১৪টিই নিশ্চিত করেছেন।
এই দুটি পরিবর্তন ছাড়াও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক ঝোঁক স্পষ্টভাবে বদলে গেছে। একসময় ভেনেজুয়েলার সাবেক প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজের রাজনৈতিক আদর্শ, নীতি ও আন্দোলনকে ঘিরে গড়ে ওঠা জনপ্রিয় মতবাদ ‘চাভিজমো’ এখন বহু দেশে অপ্রিয়। ব্রাজিল, চিলি, মেক্সিকো ও কলম্বিয়ার মতো বাম ঘরানার সরকারগুলোও হুগো চাভেজের উত্তরসূরি মাদুরোর সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছে। বিশেষ করে, ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর।
কঠিন আঞ্চলিক বাস্তবতা
লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে দীর্ঘদিন ধরেই বাম ও ডান মতাদর্শের মধ্যে পালাবদল চলছে। কিন্তু ভেনেজুয়েলা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। দেশটিতে বহু বছর ধরেই নির্দিষ্ট একটি দল শাসন করছে। হুগো চাভেজের মৃত্যুর পর এই দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন এখন তাঁরই শিষ্য নিকোলাস মাদুরো।
প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সীমান্ত ও মাদক পাচারের জটিল সম্পর্কের কারণে কলম্বিয়া সব সময়ই ভেনেজুয়েলার কাছ থেকে সতর্ক দূরত্বে থেকেছে। তবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো কলম্বিয়ার ক্ষমতায় এসে ভেনেজুয়েলার সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করলেও সম্প্রতি তিনি মাদুরোকে ‘গণতন্ত্র সংকট’–এর জন্য দায়ী বলে মন্তব্য করেছেন।
আর্জেন্টিনার ক্ষেত্রেও একই চিত্র। নেস্তর ও ক্রিস্টিনা কির্শনারের যুগে ভেনেজুয়েলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল আর্জেন্টিনার। কিন্তু ২০১৫ সালে মাউরিসিও মাক্রি ক্ষমতায় আসার পরই সেই যোগাযোগ প্রায় ছিন্ন হয়ে যায়। আর সর্বশেষ ২০২৩ সালে নির্বাচিত আর্জেন্টিনার নতুন প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মিলেই ইতিমধ্যেই মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন।
এ ছাড়া ইকুয়েডর, এল সালভাদর ও বলিভিয়াও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বামপন্থা থেকে ডানপন্থার দিকে সরে গেছে।
মাদুরোর পাশে এখন কারা
বর্তমানে মাদুরোর দৃশ্যমান প্রধান দুই মিত্র হলো—কিউবা ও নিকারাগুয়া।
কিউবা আনুষ্ঠানিকভাবে ভেনেজুয়েলাকে সমর্থন করলেও ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশটির সামরিক সহায়তা দেওয়ার সামর্থ্য নেই।
নিকারাগুয়ার প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল ওর্তেগা মাঝে মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করলেও বাস্তবিক অর্থে ভেনেজুয়েলাকে তিনি কোনো সহযোগিতা করেননি।
যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ও মাদুরোর অবস্থান
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অপারেশন সাউদার্ন স্পিয়ার’ এর অংশ হিসেবে ক্যারিবীয় অঞ্চলে ১৫ হাজার সেনা ও একাধিক যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন রয়েছে। হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলা বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকও করেছেন।
তবে মাদুরো তাঁর চিরাচরিত ভঙ্গিতে প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘হুমকি, অবরোধ, যুদ্ধ—কিছুই আমাদের ভেঙে দিতে পারেনি।’ গোপনে তিনি কূটনৈতিক আলোচনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এমন খবর জানা গেলেও তিনি আগেভাগে কোনো কার্ড প্রকাশ করতে নারাজ। তাঁর আশা—ওয়াশিংটন শেষ পর্যন্ত এই সংঘাত পরিস্থিতি থেকে পিছু হটবে, কারণ মার্কিন জনগণ বিদেশে কোনো সংঘাতে এখন আগ্রহী নয়।