রাশিয়ার ৭৫ বছর বয়সী বিজ্ঞানী ভ্লাদিমির আর্সেনেভ কেন মস্কোর রেড স্কয়ারে নিজের ওপর আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন, সেই বিষয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রয়টার্স। মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, দেশটির প্রতিরক্ষা খাতের তীব্র চাপেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন আর্সেনেভ।
আর্সেনেভ মূলত মস্কো-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘ভোলনা সেন্ট্রাল সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর প্রধান। এই প্রতিষ্ঠানটি এমন সব হেলমেট রেডিও কন্ট্রোল ডিভাইস উপাদান করে, যেগুলো যুদ্ধ ক্ষেত্রে ট্যাংক ক্রুরা ব্যবহার করেন।
২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের সময় আর্সেনেভের কোম্পানিতে একের পর এক প্রতিরক্ষা আদেশ আসতে থাকে। কিন্তু সেই আদেশগুলো তাঁর কাছে বিষের মতো জটিল ও বিপজ্জনক ছিল বলে জানিয়েছেন রয়টার্সকে। তাঁকে উৎপাদন দ্রুত বাড়াতে হয়েছিল এবং আদেশ অনুযায়ী রেডিও ডিভাইস কন্ট্রোলগুলো রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত সময়সীমা এবং মূল্যে ডেলিভারি দিতে হয়েছিল। ব্যর্থতার কোনো সুযোগ ছিল না।
এদিকে ২০২৩ সালের বসন্তে আর্সেনেভের কারখানা উৎপাদনে পিছিয়ে পড়ে এবং শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয়। সংস্থাটি তখন দেউলিয়া হওয়ার পথে। এ অবস্থায় ২০২৪ সালে ২৬ জুলাই মস্কোর রেড স্কয়ারে যান আর্সেনেভ। ক্রেমলিনের বাইরেই সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা লেনিনের সমাধির কাছে নিজের শরীরে তিনি আগুন ধরিয়ে দেন। গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় পরে তিনি কয়েক সপ্তাহ হাসপাতালে ছিলেন।
আর্সেনেভ বলেন, ‘আমাদের কাজ ঠিকঠাক চলছে, আমরা আদেশ পূরণ করছি, তারপরও কেন আমরা ডুবে যাচ্ছি। সম্ভবত সমস্যা আছে।’ শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর ক্রেমলিন ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আর্সেনেভের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
তবে ওই ঘটনায় রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পের চাপ স্পষ্ট হয়েছে বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত রাশিয়ায় অন্তত ৩৪ জনকে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা আদেশে বিঘ্ন ঘটানোর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে অন্তত ১১ জনই কোম্পানির প্রধান।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন—ক্রেমলিনের নীতি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রোস্টেকের মাধ্যমে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, উদ্ভাবন ও আধুনিকীকরণের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। রেডিও কন্ট্রোল ডিভাইস উৎপাদনের অতিরিক্ত চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল আর্সেনেভের প্রতিষ্ঠান। উৎপাদন বাড়ানোর প্রচেষ্টা এবং সরকারের সঙ্গে মূল্য নিয়ে দর-কষাকষি কোম্পানিটিকে আর্থিক সংকটে ফেলে। একপর্যায়ে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে অক্ষম এই প্রতিষ্ঠানটি মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ে।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পে চাপের উদাহরণ আরও দেখা যায় দেশটির নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান দিমিত্রি মেদভেদেভের বক্তব্যে। ২০২৩ সালের মার্চে শিল্প নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি স্তালিনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন একটি টেলিগ্রাম পড়ে শোনান, যেখানে সময়মতো অস্ত্র সরবরাহ করতে ব্যর্থ কোম্পানিকে ‘গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে’ বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল।
চিকিৎসার মধ্যে থেকেও আর্সেনেভকে এখনো তাঁর দায়িত্ব পালন করে যেতে হচ্ছে। তবে আদালতের শুনানিতে অংশগ্রহণই এখন তাঁর দিনের প্রধান কাজ। এ ছাড়া রেড স্কয়ারের মতো সংবেদনশীল স্থানে অনুমোদনহীন প্রতিবাদ করার জন্য তাঁকে বিপুল পরিমাণ জরিমানা করা হয়েছে।
এই ঘটনাটি রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পে প্রশাসনিক চাপ, সময়সীমার বাধ্যবাধকতা, আর্থিক অস্থিতিশীলতা ও আমলাতন্ত্রের চরম বাস্তবতা তুলে ধরেছে।