হোম > স্বাস্থ্য

সাধারণের স্বাস্থ্যসেবা: মিলিয়ে যাচ্ছে ‘সূর্যের হাসি’

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা

আর্থিক সংকট ও অব্যবস্থাপনায় ডুবতে বসেছে প্রায় তিন দশক ধরে দেশের দরিদ্র মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া ‘সূর্যের হাসি ক্লিনিক’। এই অবস্থার জন্য বহুলাংশে দায়ী করা হয় ক্লিনিকের বর্তমান কর্তৃপক্ষকে। রয়েছে আর্থিক অস্বচ্ছতা, অদক্ষতা এবং অনিয়মের অভিযোগও। এভাবে গত চার-পাঁচ বছরে ক্লিনিকের সংখ্যা ৪০০ থেকে কমে ৬০টিতে এসেছে। পড়েছে সেবার মানও।

স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে নেটওয়ার্ক একসময় মাতৃমৃত্যু কমানো এবং পরিবার পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, সেই নেটওয়ার্কের দ্রুত সংকোচন দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য নেতিবাচক। ক্লিনিক বন্ধ হওয়ায় অনেক এলাকায় দরিদ্ররা আগের মতো সুলভে সেবা পাচ্ছে না।

এসএইচএন কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, তারা লোকসানে থাকা ইউনিটগুলো হস্তান্তর করে নেটওয়ার্ককে টেকসই করার চেষ্টা করছে।

জানা যায়, সূর্যের হাসি ক্লিনিকের যাত্রা শুরু ১৯৯৭ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন এনজিওকে নিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক ‘সূর্যের হাসি’। দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য, টিকাদান, পরিবার পরিকল্পনা, সাধারণ রোগব্যাধি এবং ল্যাব সেবার মাধ্যমে দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেবা মডেল হিসেবে দাঁড়ায় সূর্যের হাসি ক্লিনিক।

২০১৮ সালে ইউএসএআইডির প্রকল্পকাঠামো শেষ হলে ক্লিনিকগুলো একীভূত হয়ে ‘সূর্যের হাসি নেটওয়ার্ক-এসএইচএন’ নামে একটি অলাভজনক কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়। সে সময় লক্ষ্য ছিল টেকসইভাবে দেশব্যাপী স্বল্পমূল্যের স্বাস্থ্যসেবা চালু রাখা। শুরুতে বড় কর্মী বাহিনী, আউটরিচ নেটওয়ার্ক, স্যাটেলাইট সেবা এবং মাতৃস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে এটি দেশের অন্যতম বৃহৎ প্রাইমারি হেলথ নেটওয়ার্ক হিসেবে পরিচিত হয়।

সূর্যের হাসি নেটওয়ার্কের (এসএইচএন) কেন্দ্রীয় কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ ও ২০২০ সালে দুই দফায় ক্লিনিকের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়। সেই সময়ে ১৩৪টি ক্লিনিক নিয়ে নেটওয়ার্ক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে অর্ধেকের বেশি ক্লিনিক স্থানীয়দের বা বিভিন্ন সংস্থার কাছে হস্তান্তর করা হয়; যার বড় একটি হস্তান্তর হয় চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে। বর্তমানে এই নেটওয়ার্কের ক্লিনিকের সংখ্যা ৬০।

ইউএসএআইডির অর্থায়ন বন্ধ হয়ে গেলে এসএইচএন আর্থিকভাবে চাপের মুখে পড়ে। কর্তৃপক্ষ ব্যয় কমানো, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো এবং পুনর্গঠনের নামে ব্যাপক রদবদল শুরু করে। এতে কয়েক হাজার কর্মী চাকরি হারান; যাঁদের মধ্যে ডাক্তার, নার্স, মিডওয়াইফ, টেকনোলজিস্ট ও মাঠকর্মীরাও রয়েছেন।

অভিযোগ রয়েছে, সিংহভাগ ক্লিনিক হস্তান্তর করা হয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের হাতে। কিছু এলাকায় ক্লিনিক চললেও সেবার মান কমে যাওয়ায় রোগীদের আস্থা নষ্ট হয়েছে। অন্যদিকে ক্লিনিক বন্ধ হওয়ার পেছনে শীর্ষ কর্মকর্তাদের অদক্ষতা, স্বেচ্ছাচারিতা এবং পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে অন্তঃকোন্দলকে দায়ী করেছেন কর্মকর্তারা।

এসএইচএন সূত্রে জানা যায়, সূর্যের হাসি নেটওয়ার্কের বর্তমান ক্লিনিকগুলোর মধ্যে ৩২টি অ্যাডভান্সড, ৬টি নরমাল ডেলিভারি ক্লিনিক এবং ২২টি বেসিক ক্লিনিক রয়েছে।

অ্যাডভান্সড ক্লিনিকগুলো ছোট আকারের ‘কমিউনিটি হাসপাতাল’-এর মতো কাজ করে; যেখানে মাতৃস্বাস্থ্য, নবজাতক সেবা, পরিবার পরিকল্পনা, ল্যাব টেস্ট, সাধারণ রোগব্যাধির চিকিৎসা, টিকাদান এবং বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায়। নরমাল ডেলিভারি ক্লিনিকগুলো মূলত স্বাভাবিক প্রসব করানো, গর্ভকালীন ও প্রসব-পরবর্তী পরিচর্যা এবং নবজাতকের জরুরি সেবার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। এসব ক্লিনিকে প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ ও নার্স ২৪ ঘণ্টা সেবা দেন এবং জটিল ক্ষেত্রে পাশের হাসপাতালে রেফার করেন। বেসিক ক্লিনিকগুলো প্রান্তিক এলাকায় সাধারণ চিকিৎসা, গর্ভবতী মায়েদের চেকআপ, শিশু টিকাদান, পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রী বিতরণ, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যশিক্ষা এবং রেফারেল সেবা দিয়ে থাকে।

এসএইচএনের সেবাকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ৩৬টি ফার্মেসি ও ২৪টি ডিসপেনসারি, যেগুলোর কয়েকটি সম্প্রতি ক্লিনিকের বাইরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এসব ফার্মেসিতে কম দামে মৌলিক ওষুধ, গর্ভনিরোধক সামগ্রী, শিশু উপযোগী সিরাপ, ওআরএস, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা-কিট এবং ফার্মাসিস্টের পরামর্শ পাওয়া যেত। অপরদিকে ডিসপেনসারিগুলো ছোট পরিসরের চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে; যেখানে সাধারণ রোগের চিকিৎসা, ফার্স্ট এইড, সীমিত ল্যাব সুবিধা, প্রাথমিক টিকাদান এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করা হয়।

সূর্যের হাসি নেটওয়ার্কের শীর্ষ পর্যায়ে কর্মরত রয়েছেন অথবা চাকরিচ্যুত হয়েছেন এমন অন্তত ১৫ জন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০২৩ সালে ইউএসএআইডির সঙ্গে নেটওয়ার্ক কর্তৃপক্ষের মতবিরোধ শুরু হয়। ওই বছরের পর নতুন করে আর অর্থায়ন করেনি ইউএসএআইডি। বর্তমানের ৬০টি ক্লিনিকের কয়েকটি বাতিল করার প্রক্রিয়া চলছে।

দীর্ঘদিন এই নেটওয়ার্কে কাজ করেছেন এমন তিনজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে জানান, ক্লিনিকের আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এই ক্লিনিক সারা দেশে ভালো মানের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে এসেছে। কিন্তু বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তা নিয়োগের পর জটিলতা শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানের ক্লিনিকগুলোকে স্থানীয় প্রভাবশালীদের বা অন্যদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়।

গত বছরের ডিসেম্বরে করা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওই অর্থবছরে আয়ের উৎসগুলো হলো—মাইলস্টোনভিত্তিক অনুদান ১৫ কোটি ৬ লাখ টাকা, ক্লিনিক সেবা ও ফার্মেসি বিক্রয় থেকে ৫৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া সরকার থেকে বিশেষ অনুদান ১৫ কোটি টাকা ও অন্যান্য আয় ২ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ক্লিনিক ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ১৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা লোকসান করেছে।

স্থানীয়দের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে এমন অন্তত তিনটি ক্লিনিকের তৎকালীন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্লিনিকগুলো হস্তান্তরের প্রক্রিয়া যথাযথভাবে হয়নি। এর মধ্যে মেহেরপুর সদর উপজেলার ক্লিনিকটি (কোড ৩২৫) বর্তমানে স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি চালাচ্ছেন। এতে ক্লিনিকের মান বজায় রাখতে পারছে না বলে জানিয়েছেন সেখানকার এক সাবেক কর্মকর্তা।

জানতে চাইলে নেটওয়ার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শায়লা পারভীন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শুরু থেকে সূর্যের হাসি ক্লিনিকের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল না। ২৫টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ক্লিনিকগুলো পরিচালনার দায়িত্বে ছিল। তখন তাদের নেতৃত্বে ক্লিনিকগুলো ভালোভাবে চলেনি। প্রতি পাঁচ বছরের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের নামে ক্লিনিকগুলো পরিচালিত হতো। অধিকাংশ ক্লিনিক ভাড়া করা বাড়িতে থাকায় পরিচালনা ব্যয়বহুল ছিল। এতে অনেক খরচ হতো এবং পরে ইউএসএআইডি আর অনুদান দিতে চায়নি। ২০১৯ ও ২০২০ সালে দুই দফায় আড়াই শতাধিক ক্লিনিক হস্তান্তর করা হয়। ক্লিনিক কমানো ইউএসএআইডির পরিকল্পনা ছিল। কারণ, সংস্থাটি এখন বিশ্বব্যাপী প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ করছে না এবং সূর্যের হাসি নিয়ে ভবিষ্যৎ দেখেনি। আমি ২০২০ সালের ডিসেম্বরে যোগদানের পর ক্লিনিকগুলো দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি।’

ক্লিনিকগুলো কেন হস্তান্তর করা হলো, এমন প্রশ্নে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘এটি নিতান্ত বাধ্য হয়ে করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্লিনিক ভাড়া করা বাড়িতে হওয়ায় স্থানীয়রা পরে নিজ উদ্যোগে পরিচালনা করতে চেয়েছেন। আর আমাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা কমে গিয়েছিল। এখন যেসব ক্লিনিক হস্তান্তর করা হয়েছে, সেগুলো ‘সূর্যের আলো’ নামে চলছে। আমরা তাদের পরিচালনা করতে দিয়েছি, তারা কর্মীদের বেতন দেবে। কিন্তু ভবিষ্যতে আমরা আবার ক্লিনিকগুলো ফিরে পাব। গত দেড় দশকে ক্লিনিকগুলোতে ভালো বিনিয়োগ হয়নি। ফলে সেবার মান ধরে রাখা কঠিন হয়েছে।’

আর্থিক স্বচ্ছতার অভিযোগ সম্পর্কে শায়লা পারভীন বলেন, ইউএসএআইডির কোনো অর্থই হিসাব ছাড়া খরচ হয়নি। তারা হিসাব নিয়েছে। সরকারের ১৫ কোটি টাকার অনুদানও সঠিকভাবে খরচ হয়েছে এবং সরকারকে জানানো হয়েছে।

ব্লাড ক্যানসার আর মরণব্যাধি নয়, জিন থেরাপিতে অভাবনীয় সাফল্য

অনেক গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিক আর তেমন কাজ করছে না: গবেষণা

পুরুষদের টাক সমস্যার সমাধান মিলল ৫ বছর আগের এক ব্রণের ওষুধে

ওষুধ খাতে এপিআই নীতি দ্রুত বাস্তবায়নে প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান

দেশে এ বছর ৪ কোটি ২৫ লাখ শিশু টাইফয়েড টিকা পেয়েছে

স্বাস্থ্যের ডিজির সঙ্গে তর্কের পর সেই চিকিৎসককে অব্যাহতি ও শোকজ নোটিশ

নাক ডাকা: কারণ, ঝুঁকি এবং প্রতিকার

চোখের যেসব রোগ পুরুষদের বেশি হয়

পিঠব্যথা: কারণ, লক্ষণ ও করণীয়

সবজি সংরক্ষণ করবেন যেভাবে