কয়েক বছর আগেও যে চিকিৎসা পদ্ধতিকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির মতো মনে হতো, সেটিই এখন দুরারোগ্য ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ করে তুলছে। ব্রিটিশ একদল চিকিৎসক বলছেন, নতুন এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে (জিন থেরাপি) রোগীর শরীরের শ্বেত রক্তকণিকার ডিএনএ অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সম্পাদনা করা হয়, যাতে এগুলো ক্যানসার ধ্বংসকারী একপ্রকার ‘জীবন্ত ওষুধে’ পরিণত হয়।
২০২২ সালে প্রথম এই চিকিৎসা নিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের লিসেস্টারের কিশোরী আলিসা ট্যাপলি। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি শুরু থেকে আলিসার ট্রিটমেন্টের খোঁজ রাখছিল। বিবিসি বলছে, তিনি এখন সম্পূর্ণ ক্যানসারমুক্ত। এখন তার লক্ষ্য ভবিষ্যতে একজন ক্যানসার বিজ্ঞানী হওয়া।
টি-সেল অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়ায় (রক্ত ও অস্থি মজ্জার ক্যানসার) আক্রান্ত আরও আটজন শিশু ও দুজন প্রাপ্তবয়স্ককে এই থেরাপি দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (৬৪ শতাংশ) রোগী এখন সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পথে।
যে রোগীরা এই ট্রায়ালে ছিল, তাদের ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি ও বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট—সব চিকিৎসাই ব্যর্থ হয়েছিল। চিকিৎসকদের ভাষায়, পরীক্ষামূলক এই চিকিৎসা ছাড়া তাঁদের সামনে ছিল কেবল ‘আরামদায়ক মৃত্যু নিশ্চিত করা’র পথ। ১৬ বছর বয়সী আলিসা বলেছেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, আমি মারা যাব। আমি আর বড় হতে পারব না।’
বিশ্বখ্যাত গ্রেট অরমন্ড স্ট্রিট হাসপাতালের চিকিৎসকেরা আলিসার শরীরের পুরোনো প্রতিরোধী ব্যবস্থা নষ্ট করে নতুন প্রতিরোধী ব্যবস্থা তৈরি করেন। তাকে চার মাস হাসপাতালে কাটাতে হয়, ভাইয়ের সঙ্গেও দেখা করতে পারেনি সংক্রমণের আশঙ্কায়। এখন তার দেহে ক্যানসারের কোনো জীবাণু নেই এবং বছরে একবার চেকআপ ছাড়া আর চিকিৎসা লাগে না।
এই চিকিৎসায় ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন ও গ্রেট অরমন্ড স্ট্রিট হাসপাতালের গবেষকেরা ব্যবহার করেছেন ‘বেস এডিটিং’ নামে একটি প্রযুক্তি।
ডিএনএর চার প্রকার বেস—এ, সি, জি ও টি (অ্যাডেনিন, সাইটোসিন, গুয়ানিন এবং থাইমিন) হলো আমাদের জেনেটিক কোডের মূল ভিত্তি। বেস এডিটিং পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীরা ডিএনএর নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে মাত্র একটি বেস বদলে দেন, অর্থাৎ জীবনের নির্দেশনামা নতুনভাবে লিখে দেন।
এই পদ্ধতিতে সুস্থ দাতার দেওয়া টি-সেল নেওয়া হয় এবং চার ধাপে জিন সম্পাদনা করা হয়। সম্পাদিত টি-সেল রোগীর শরীরে ঢোকার পর সব ক্যানসার বা অসুস্থ টি-সেল ধ্বংস করতে থাকে। থেরাপি প্রয়োগের চার সপ্তাহ পর যদি ক্যানসার ধরা না পড়ে, তখন রোগীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বোন ম্যারো প্রতিস্থাপন করানো হয়।
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মোট ১১ জন রোগীর ওপর এই পদ্ধতির ট্রায়াল চালানো হয়। এর মধ্যে ৯ জন পুরোপুরি সুস্থ হন এবং পরে তাদের বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করানো হয়। সাতজন রোগী চিকিৎসার তিন মাস থেকে তিন বছর পরও রোগমুক্ত আছেন।
তবে এই পদ্ধতিতে কিছু ঝুঁকিও আছে। প্রধান ঝুঁকি হলো—একজন মানুষের শরীরের পুরো প্রতিরোধী ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ায় মারাত্মক সংক্রমণের সম্ভাবনা।
কিংস কলেজ হাসপাতালের ডা. ডেবোরা ইয়ালপ বলেন, ‘যে রোগগুলোর চিকিৎসা সম্পূর্ণ অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল, আমরা সেগুলোর ক্ষেত্রেও সফলতা পেয়েছি।’ স্টেম সেল চ্যারিটি অ্যান্থনি নোলানের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. তানিয়া ডেক্সটারের ভাষায়, ‘এই রোগীদের বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। তবে এই চিকিৎসা পদ্ধতি নতুন আশা দিচ্ছে।’
গ্রেট অরমন্ড স্ট্রিট হাসপাতালের প্রফেসর ওয়াসিম কাসিম বলেন, ‘কয়েক বছর আগে এটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির মতো ছিল। এখন সেটা বাস্তবে পরিণত হয়েছে।’
এর আগে জিন থেরাপির মাধ্যমে মাত্র তিন বছরের একটি শিশুর উন্নতি দেখে চিকিৎসকেরা বিস্মিত হয়েছিলেন। হান্টার সিনড্রোম বা এমপিএস-২ নামে পরিচিত এই রোগে আক্রান্ত ওই শিশু এখন জিন থেরাপির মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে।