শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আমাদের সুস্থ রাখার জন্য তৈরি হলেও, কখনো কখনো এই প্রতিরক্ষা ব্যূহই ‘বিশ্বাসঘাতক’ হয়ে ওঠে। যখন এই ব্যবস্থা ভুলবশত শরীরের নিজস্ব কোষ ও কলার ওপর আক্রমণ শুরু করে দেয়, তখন তাকে ‘অটোইমিউন রোগ’ বলা হয়। এই রোগ বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষকে প্রভাবিত করে। এর প্রকোপ ক্রমশ বাড়ছে।
শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গকেই এই রোগ প্রভাবিত করতে পারে। যদিও নারীদের মধ্যে এর প্রবণতা চার গুণেরও বেশি। তবে শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক—যেকোনো বয়সী ব্যক্তিই এই রোগের শিকার হতে পারেন।
বর্তমানে অটোইমিউন রোগের চিকিৎসায় এক নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনকার গবেষণা শুধু রোগের লক্ষণ কমানোর পরিবর্তে, বিদ্রোহী হয়ে ওঠা ইমিউন সিস্টেমকে পুনরায় প্রোগ্রাম করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে।
নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ল্যাংগোন হেলথ-এর রিউমাটোলজিস্ট ড. অমিত সাক্সেনা এই সময়কে ‘অটোইমিউন গবেষণার জন্য সবচেয়ে উৎসাহব্যঞ্জক সময়’ বলে অভিহিত করেছেন। বর্তমানে লুপাস, মায়োসাইটিস-সহ অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় এই নতুন পদ্ধতিগুলোর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে এবং কিছু প্রাথমিক সাফল্যও দেখা গেছে। এ ছাড়া, গবেষকেরা টাইপ-১ ডায়াবেটিসের মতো রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার আগেই তা বিলম্বিত করার পথ খুঁজছেন।
অটোইমিউন রোগের প্রকৃতি
অটোইমিউন রোগগুলো সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয়। এর তীব্রতা হালকা থেকে মারাত্মক হতে পারে। এ ধরনের রোগের সংখ্যা ১০০ টিরও বেশি। এগুলো কোনো একটি শরীরের কোথায় এবং কীভাবে ক্ষতি করছে তার ওপর ভিত্তি করে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত।
যেমন, রিউমাটয়েড আর্থরাইটিস গাঁটে আক্রমণ করে। সজোগ্রেনস রোগের প্রধান লক্ষণ চোখ ও মুখ শুকিয়ে যাওয়া। লুপাসের উপসর্গগুলো অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়—যার মধ্যে মুখমণ্ডলে প্রজাপতি-আকৃতির ফুসকুড়ি, গাঁটে ব্যথা এবং কিডনি, ফুসফুস ও হৃদ্যন্ত্রের ক্ষতি অন্যতম।
এই রোগগুলোর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, রোগী দীর্ঘকাল ভালো থাকার পরেও হঠাৎ করেই কোনো আপাত কারণ ছাড়াই রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
রোগ নির্ণয় কেন এত কঠিন?
এই রোগগুলো নির্ণয় করা কঠিন কারণ এর প্রাথমিক লক্ষণগুলো প্রায়শই অস্পষ্ট হয়। লক্ষণগুলো অন্য অনেক সাধারণ অসুস্থতার সঙ্গে মিলে যায়। অনেক ক্ষেত্রে সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য বেশ কয়েকটি রক্ত পরীক্ষা এবং একাধিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে বছরখানেক সময় লেগে যেতে পারে।
কারণ ও ঝুঁকি
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই রোগগুলোর প্রধান কারণ কোনো একটি নির্দিষ্ট জিনগত ত্রুটি নয়। বরং, ইমিউন ফাংশনকে প্রভাবিত করে এমন একাধিক জিনের কারণে মানুষ সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। এরপর একটি ‘পরিবেশগত ট্রিগার’—যেমন কোনো সংক্রমণ, ধূমপান বা দূষণ—রোগটিকে সক্রিয় করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, এপস্টাইন-বার ভাইরাস মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস (এমএস)-এর সঙ্গে সম্পর্কিত।
নারীদের ঝুঁকি বেশি
অটোইমিউন রোগীদের প্রায় ৮০ শতাংশই নারী। বিজ্ঞানীদের ধারণা, হরমোন এবং নারীদের দুটি এক্স ক্রোমোজোম সংক্রান্ত কিছু অস্বাভাবিকতার কারণে নারীরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হন। তবে পুরুষেরাও এই রোগে ভোগেন। যেমন, ভেক্সাস সিনড্রোম নামক একটি গুরুতর রোগ ৫০ বছরের বেশি বয়সী পুরুষদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়।
চিকিৎসা পদ্ধতি ও খরচ
বিনিয়োগ গবেষণা সংস্থা মর্নিংস্টার অনুসারে, অটোইমিউন রোগের চিকিৎসার বৈশ্বিক বাজার বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। চিকিৎসা সাধারণত ব্যয়বহুল এবং জীবনভর চলতে থাকে।
অল্প কিছুদিন আগেও এই রোগগুলোর চিকিৎসার জন্য উচ্চ-ডোজের স্টেরয়েড এবং ব্যাপক ইমিউন-দমনকারী ওষুধ ব্যবহার করা হতো, যার ফলে সংক্রমণ বা ক্যানসারের মতো মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি ছিল। বর্তমানে নতুন কিছু ওষুধ এসেছে যা নির্দিষ্ট অণুগুলোকে লক্ষ্য করে কাজ করে, ফলে এটি কিছুটা কম ক্ষতিকারক। তবে এখনো অনেক অটোইমিউন রোগের ক্ষেত্রে সঠিক চিকিৎসা খুঁজে পেতে ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ বা বারবার পরীক্ষা করার পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়।
তথ্যসূত্র: এপি