তখন ঈশ্বরদী লোকোশেডের ফায়ারম্যান হিসেবে চাকরি করছেন জসীম মণ্ডল। ঈশ্বরদী থেকে ট্রেন নিয়ে যান আননুরায়, আবার ফিরে আসেন। দেশের খাদ্য পরিস্থিতি ভালো নয়। দুর্ভিক্ষের আলামত দেখা যাচ্ছে। নিয়ম হয়েছে, এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেন খাদ্য পাচার না হয়।
আননুরা থেকে জসীম মণ্ডল বাড়ির জন্য তিন মণ চাল কিনেছিলেন। তাঁদের রেশন শপে চাল দেওয়া হতো না, দেওয়া হতো খুদ। তাই ড্রাইভার-ফায়ারম্যানরা আননুরা থেকে বাড়ির জন্য দুই-এক মণ চাল কিনে আনতেন। ট্রেন রাজশাহী পৌঁছালে মিলিশিয়ারা গাড়ি চেক করতে গিয়ে সেই চাল নামিয়ে নিলেন। মনে করলেন, চাল পাচার হচ্ছে। জসীম মণ্ডল বহু অনুনয়-বিনয় করলেন, কিন্তু কোনো কাজ হলো না। মাথায় রক্ত চড়ে গেল। শাবল আর ব্যাগ হাতে নিয়ে তিনি বসলেন প্ল্যাটফর্মের গাছের তলায়। সহকারী ফায়ারম্যানও তাঁর পিছু পিছু নেমে এলেন। ড্রাইভার বললেন, ‘জসীম, ইঞ্জিন থেকে নেমে যাচ্ছ কোথায়?’
জসীম বললেন, ‘ট্রেন চালাব না। আমার চাল ফেরত চাই, তারপর ট্রেন চলবে।’
ট্রেনের ঘণ্টা বাজল, গার্ডের হুইসেল বাজল, সবুজ ঝান্ডা উড়ল, কিন্তু ট্রেন আর চলে না। আরেকটি লোকাল ট্রেন এল ঈশ্বরদী থেকে। সেটাও যোগ দিল ধর্মঘটে। যে যাত্রীরা চাল নিয়ে যাচ্ছিল, তারাও দাঁড়াল জসীমের সমর্থনে। প্রবীণ কমরেড খোকা রায় খবর পেয়ে হাজির হলেন। বললেন, ‘চালাও জসীম, পরোয়া নেই।’
চাল না দিলে ধর্মঘট ভাঙবে না—এই হলো ধনুর্ভঙ্গপণ।
ম্যাজিস্ট্রেট এসে বললেন, ‘আপনাদের হঠকারিতায় সরকারের কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে জানেন?’
জসীম বললেন, ‘অবশ্যই জানি, কিন্তু এ তো আমার বেতনের টাকায় কেনা চাল। চুরিও করিনি, ব্ল্যাকের ব্যবসাও করছি না।’
ম্যাজিস্ট্রেট কান দিলেন না কথায়। তবে ডিসি এসে মিলিশিয়াদের গুদাম থেকে আটক চাল নিয়ে ট্রেনে উঠতে দিলেন জসীম মণ্ডলকে।
সূত্র: জসীম উদ্দীন মণ্ডল, জীবনের রেলগাড়ি, পৃষ্ঠা ৬০-৬২