একসময়ের সোভিয়েত রাশিয়া ছিল আমেরিকাসহ পশ্চিমা ধনবাদী পুঁজিপতিদের আতঙ্ক। সাম্রাজ্যবাদী এই পুঁজিপতিরা সব সময়ই ভয় করত সোভিয়েত ইউনিয়নকে। বিশ্বের মেহনতী শ্রমজীবী মানুষের একমাত্র আশ্রয় ও ভরসাস্থল ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের, অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক আদর্শের মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকল। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বেশ কয়েকটি দেশ মেহনতী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শামিল হলো।
আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব ভাবল তাদের পুঁজি বিনিয়োগের জায়গা সংকুচিত হয়ে আসছে; শোষণের জায়গা, বিশেষ করে শ্রমের শোষণ ও মানুষে মানুষে বৈষম্যের কারণে পুঁজি বিস্তার অনেকটাই বাধার মুখে পড়ছে। পশ্চিমা বিশ্ব তাদের পরিকল্পনা প্রসারিত করতে আরম্ভ করল। যে করেই হোক সোভিয়েত রাশিয়াকে ১৫টি রাষ্ট্রে বিভক্ত করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা বদলে গেল; অর্থাৎ শোষণমুক্ত সমাজের চিন্তাভাবনা তিরোহিত হলো। প্রায় ৭২ বছরের এ প্রক্রিয়াটি বিলুপ্ত হলো রক্তপাতহীনভাবে। বলতে গেলে স্বাভাবিকভাবে অবলুপ্ত হয়ে গেল। ওয়ারশ জোট ভেঙে গেল। ওয়ারশ জোটের দেশগুলো, সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি দেশ স্বাধীনভাবে যার যার মতো করে রাজ্য পরিচালনা করতে আরম্ভ করল। বার্লিন প্রাচীর ভেঙে গেল। পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিন একত্র হয়ে গেল। পশ্চিমা বিশ্ব শান্তির ঢেকুর তুলল। বিনা শ্রমে, বিনা রক্তপাতে সামরিক শক্তি ব্যয় ছাড়া বিনা যুদ্ধে, আকাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করল।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জ্যেষ্ঠ বুশ ও তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিস্টার বেকার ঘোষণা করলেন ন্যাটো এক ইঞ্চিও আর পূর্ব দিকে অগ্রসর হবে না। সারা বিশ্বের ৬০০ কোটি মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। পৃথিবী থেকে শীতল যুদ্ধের অবসান হয়েছে, এই পৃথিবী হবে শান্তির পৃথিবী। অস্ত্র প্রতিযোগিতা হবে না, ঠান্ডা যুদ্ধ চলবে না, জাতিতে জাতিতে ভেদাভেদ থাকবে না। প্রতিটি রাষ্ট্র নিজের মতো করে মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটিয়ে, প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটিয়ে, মানবজীবনকে শান্তিময় পৃথিবীতে বসবাসের সুযোগ করে দেবে।
পৃথিবীব্যাপী শুধু এই পৃথিবী থেকে রোগ-শোক, ক্ষুধা-দারিদ্র্য, অশিক্ষা-কুশিক্ষা দূর করে শান্তির পৃথিবী সামনের দিকে অগ্রসর হবে, সেটাই ছিল শান্তিকামী মানুষের চাওয়া।
পশ্চিমা বিশ্বসহ আমেরিকা কিছুদিনের মধ্যেই সবকিছু ভুলে গেল। ন্যাটো জোট সম্প্রসারিত হতে লাগল। ন্যাটো জোটের ১২টি দেশ থেকে ৩০টি দেশে তাদের সম্প্রসারণ ঘটাল। ওয়ারশ জোটের প্রায় সবগুলো দেশ ও তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের তিনটি দেশ লিথুনিয়া, ইস্তোনিয়া ও লাটভিয়াকে ন্যাটো জোটের অন্তর্ভুক্ত করল। আমেরিকা ও পশ্চিমাদের সম্প্রসারণনীতি ক্রমেই আগ্রাসী রূপ ধারণ করল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন বরিস ইয়েলৎসিন। দুর্বল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। মদ্যপ অবস্থায় পড়ে থাকতেন দিনের বেশির ভাগ সময়। সেই সময়ে রাশিয়া সরকারের দুর্বলতার কারণে যা ঘটার ঘটে গেল। সম্প্রসারণ ঘটে গেল ন্যাটোসহ পশ্চিমাদের অগ্রসরমাণ নীতি।
২০০০ সালে ক্ষমতায় এলেন ভ্লাদিমির পুতিন। সবকিছু পেছনে ফেলে নিজের দেশের অর্থনীতি ও সামরিক শক্তিকে এগিয়ে নিলেন; বিশেষ করে গভীরভাবে অনুধাবন করলেন, যে কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল, ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান হলো, তা তো হচ্ছে না পশ্চিমা আগ্রাসী নীতির কারণে। ন্যাটোসহ পশ্চিমারা কোনো কথাই রাখছে না। এই চিন্তা থেকেই ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া আবার সেই সোভিয়েত আমলের মতো সমরশক্তি বৃদ্ধি করল বিশ্বকে আগ্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। রাশিয়া তার সুবিধামতো বন্ধু বেছে নিল। কিছু কিছু শক্তিধর রাষ্ট্র সরাসরি বন্ধুত্বের হাত না বাড়ালেও ভেতরে-ভেতরে তাদের নিউট্রাল করে দিল। সারা বিশ্বকে জানান দিল পৃথিবীতে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য রাশিয়া এখন প্রস্তুত।
এই যখন রাশিয়ার অবস্থা, সেই সময়ই রাশিয়ার একেবারে সীমান্তঘেঁষা ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ পশ্চিমাদের আশ্বাসের কারণে ন্যাটো জোটভুক্ত হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করল। এবার রাশিয়া ভাবল এখনই সময় আগ্রাসী তৎপরতা রুখে দেওয়ার।
আমরা যত কিছুই ভাবি না কেন, স্বাধীন দেশে আগ্রাসন, জোর যার মুল্লুক তার, রাশিয়া কোনো কিছুই পরোয়া করে না—এই সব নানান কথা বলতে পারি। সবকিছু বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, ১৯৯১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত যা যা পরিবর্তন ঘটছে, এখনো রাশিয়া হাত গুটিয়ে বসে থাকলে দশ বছরের মধ্যে সারা পৃথিবী এককেন্দ্রিক হয়ে যাবে, কোনো ভারসাম্য থাকবে না। একটি গোষ্ঠীর মোড়লিপনা, স্বেচ্ছাচারিতা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। পুতিন সবকিছু মাথায় রেখে ইউক্রেনে সামরিক অপারেশন করেছেন, এ কথাই বলছে রাশিয়া। রাশিয়া বলেছে, তারা ইউক্রেন দখল করবে না, ইউক্রেনের নতুন নাৎসিবাদী সরকারের পতন ঘটিয়ে, ইউক্রেনিয়ানদের তাদের নিজের সরকার গঠন করতে সহায়তা করে নিজের দেশে চলে আসবে।
ওপরের বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায়, আমেরিকাসহ পশ্চিমা নেতারা এই ৩০ বছরে শান্তির পৃথিবী গড়ার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
বিশ্বনেতারা ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পরে ওয়ারশ জোট ভেঙে যাওয়ার পরে কেন শান্তির পৃথিবী গড়ে তুলতে পারলেন না, এর দায় কে নেবে? সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকে চিন্তা করার অনুরোধ থাকবে, এই ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে পৃথিবী কী শিক্ষা নিল। ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় থাকবে? নাকি এককেন্দ্রিক ক্ষমতার বলয়ে থাকবে? গোটা পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষের এই বিষয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে চিন্তাভাবনা করে অগ্রসর হতে হবে।
লেখক:আব্দুর রাজ্জাক, প্রকৌশলী