তথ্যে ভুল থাকলেও আমাদের তেমন কিছু যায়-আসে না। অভিধান বলছে, মধুমাস হলো চৈত্র। আর আমজনতা মধুমাস বলতে বোঝে জ্যৈষ্ঠ। আমরা, যারা জিব বাড়িয়ে, হাত বাড়িয়ে তালগাছের মতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকি জ্যৈষ্ঠের দিকে, তাদের জন্য জ্যৈষ্ঠ মধুমাস। এ ক্ষেত্রে আমরা ‘ব্যাকরণ মানি না’র দলে।
সে যা হোক। জ্যৈষ্ঠ যখন এসেই গেছে, তখন আম, কাঁঠাল, জাম-জামরুলে চারদিক রঙিন হয়ে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। হয়েছেও তাই। মধ্য দুপুরে ছয়তলার ছাদের ক্যানটিনে খেতে উঠে আমার চোখ কেবলই চলে যায় পাশের বাড়ির ছাদে। এই হতশ্রী শহরে সে ছাদের একটি টবে লাগানো হয়েছে জামরুলগাছ। সবুজ পাতায় ছাওয়া সে গাছে ঝুলে থাকে টুকটুকে লাল জামরুল। আর আমি বিস্বাদ ‘বিমূঢ় কুক্কুট’ মানে ফার্মের মুরগির ড্রামস্টিক চিবোতে চিবোতে সে জামরুলগাছের দিকে চেয়ে থাকি অপলক। আর ভাবি, দিন দিন জামরুলের সংখ্যা কমে যাচ্ছে আমার চোখের সামনে। কিন্তু আমি অসহায়। আর তখনই আমার মনের কোণে ভেসে ওঠে, এতটা অসহায় তো ছিলাম না কোনো দিন! বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে তাদেরই গাছের কাঁচামিঠা আম পেড়ে আনার পরিকল্পনা তো আমারই ছিল কোনো এককালে। সে তো কম দুঃসাহসের কথা নয়। আজ সে বয়স নেই বলে… থাক। আক্ষেপ করে লাভ কী।
এখন আর সে দিনও নেই, সে বয়সও নেই। এখন হিসাব জানি। মে মাসের পনেরো তারিখের মধ্যে বাজারে পুরুষ্ট পাকা আম উঠতে শুরু করে। চলে জুলাই পর্যন্ত। সপ্তাহখানেক এদিক-সেদিক হয় বটে। কিন্তু এটাই সাধারণ সময়।
আম নিয়ে বাঙালির পাগলামির কি আর অন্ত আছে? খাওয়ার ঐতিহ্য তো আছেই। আছে তার তরিকাও। এক জ্যেষ্ঠ নাগরিকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আম কাটার ভালো উপায় কী? তিনি চোখের পাতা না ফেলে বলেছিলেন, বাঁশের ধারালো ছিলকা অথবা ঝিনুক। কাটারি বা ছুরি দিয়ে আম কাটা মহাপাপ। কেন? তাতে কী কী সব থাকে, যা আমের স্বাদ নষ্ট করে। আম খাওয়ার সেরা উপায়? উত্তর, গাছের তলায় তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকা। তারপর যেই গাছপাকা আম পড়বে মাটিতে, অমনি সেটা খেয়ে নেওয়া। তাহলে কি গাছের ডাল ঝাঁকিয়ে, ঢিল ছুড়ে আম খাব না? উত্তর, খাবি। তাতে অপরিপক্ব আমও থাকে। সেটার স্বাদ গাছপাকার মতো হয় না। মোদ্দা কথা, আমের আসল স্বাদ পেতে গাছে পাকা আম খেতে হবে গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে! তা না হলে নাকি ‘অভিজাত’ হওয়া যাবে না।
কিন্তু মহান মির্জা গালিব (১৭৯৭-১৮৬৯) সে রকম কোনো বিপদে পড়েননি। ‘এজিদের মতো থালায় বায়েজিদের মতো’ খানা খাওয়া মানুষ ছিলেন তিনি। উর্দু ও ফারসি কবিতা, তাজা ফুল, সুপক্ব ও মুর্শিদাবাদের সুস্বাদু আম আর কাবাব—এসব না বুঝলে মির্জা গালিবকে বোঝাই হয় না। এই যে এসেছে আমের মৌসুম, হরেক রকম আমের গন্ধে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, বাজার যখন ম-ম করতে শুরু করেছে, তখন বাংলা সাহিত্য থেকে কোট করতে গেলে সেই ‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি’তেই আপনাকে থামতে হবে। একটু অগ্রসর হলে অবশ্য রবীন্দ্রনাথের জাপান ভ্রমণে আম সঙ্গে নেওয়ার গল্পটা আসবে। আর? তেমন কিছু খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অথচ আমের মৌসুমে আপনি চোখ বন্ধ করে মির্জা গালিবকে স্মরণ করতে পারেন। গালিব বলেছিলেন, আমের দুটো গুণ থাকতে হবে, ১. হতে হবে প্রচুর মিষ্টি এবং ২. থাকতে হবে অসংখ্য। আমপ্রেমী বাঙালি, কোনো সন্দেহ আছে?