মধ্যযুগের কীর্তিমান মুসলিম ভূগোলবিদ ও মানচিত্রকর মুহাম্মদ আল-ইদরিসি। জন্ম ১১০০ সালে, স্পেনের জিব্রালটার প্রণালির সেউতা শহরে। তিনি স্পেন ও উত্তর আফ্রিকায় অল্প কিছুদিন শাসন করা হামুদ বংশের খলিফাদের নিকট-উত্তরসূরি, যাঁদের বংশধারা মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত পৌঁছে। পড়াশোনা করেছেন কর্ডোভার বিদ্যালয়গুলোতে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি এশিয়া মাইনর ভ্রমণ করেন। স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি ও ইংল্যান্ডের উপকূল পর্যন্ত তাঁর ভ্রমণ গন্তব্য ছিল। সিসিলির নরম্যান রাজা দ্বিতীয় রোজারের দরবারে তিনি ভূগোলবিদ হিসেবে ১৫ বছর কাজ করেন। মধ্যযুগের সর্বাধুনিক বিশ্ব-মাত্রচিত্র ‘ট্যাবুলা রোজারিয়ানা’ তাঁরই আঁকা। মানচিত্রের বিবরণ-সংবলিত তাঁর রচিত আরবি আকরগ্রন্থ ‘নুযহাতুল মুশতাক ফিখতিরাকিল আফাক’ থেকে ভূগোল-গবেষকেরা তিন শ বছরের বেশি সময় উপকৃত হয়েছেন।
ট্যাবুলা রোজারিয়ানা
আল-ইদরিসির পূর্বপুরুষেরা স্পেনের ক্ষমতা হারালে নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি সিসিলি পাড়ি জমান। সেখানে ১১৫৪ সালে ‘ট্যাবুলা রোজারিয়ানা’ নামের বিখ্যাত বিশ্ব-মানচিত্রটি তৈরি করেন। এটি তৈরিতে তিনি নিজের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি মুসলিম ব্যবসায়ী, পরিব্রাজক ও নরম্যান ভ্রমণকারীদের দেওয়া তথ্যের সহায়তা নেন। বাণিজ্যপথ, প্রধান শহর ও অন্যান্য ভৌগোলিক বিবরণ তাতে যুক্ত করেন। মুসলিম স্পেন এবং ইউরোপের উপকূলগুলো নিখুঁতভাবে চিত্রিত করেন। তবে সেকালে স্থলভাগ সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত না থাকায় স্পষ্ট করতে পারেননি। মানচিত্রের বিবরণ আরবিতেই লিখেছেন। ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু অংশ পুরোপুরি চিত্রিত করেন তিনি। তবে আফ্রিকার উত্তর অংশ, হর্ন অব আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার খণ্ডিত চিত্রই তাতে ফুটে উঠেছে। এই মানচিত্রে তিনি ‘আয়ারল্যান্ডা আল-কাবিরা’ নামের একটি দ্বীপ চিহ্নিত করেন, যার বিবরণ বর্তমান গ্রিনল্যান্ডকেই নির্দেশ করে। চীনা বাণিজ্যের তথ্যের পাশাপাশি তিনি কোরিয়ার শিলা রাজবংশের কথাও এনেছেন।
‘নুযহাতুল মুশতাক ফিখতিরাকিল আফাক’-এর বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘দিগন্ত চিরে স্বপ্নচারীর আনন্দভ্রমণ’। এটি আল-ইদরিসির মানচিত্রের বিবরণের সংকলন। বইটির নয়টি পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়, যার সাতটিতেই মানচিত্র যুক্ত করা আছে। ১৯৭০ সালেই বইটির পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ প্রকাশিত হয় এবং সঙ্গে পর্যালোচনা সংযুক্ত করা হয়। বইটিতে তিনি আটলান্টিক মহাসাগরের কয়েকটি দ্বীপের বিবরণও পেশ করেছেন। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের আগপর্যন্ত এই বইকে মানচিত্রকরেরা রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করতেন।
জীবনসায়াহ্নে আল-ইদরিসি জন্মভূমি সেউতায় ফিরে যান এবং ১১৬৫ সালে মারা যান।