বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে পৌষের এই শীতকাতর দুপুরে কুসুম উষ্ণতা ছড়াল তাঁর প্রতিটি কথা। যেভাবে তিনি তাঁর বারবাডিয়ান সঙ্গী ডেসমন্ড হেইন্সকে নিয়ে ক্যালিপসো সুর তুলতেন ২২ গজে, গতকাল উপস্থিত দর্শকেরা একইভাবে উপভোগ করলেন স্যার কাথবার্ট গর্ডন গ্রিনিজের প্রতিটি কথা।
ঢাকা লিট ফেস্টের চতুর্থ দিন রোববারের দুপুরটা অন্য রকম হয়ে উঠল গ্রিনিজের মুগ্ধতা ছড়ানো আলাপনে। মঞ্চে তাঁর সঙ্গী জিম্বাবুয়ের হ্যামিল্টন মাসাকাদজা আর বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক প্রথমের সাক্ষী ইউসুফ রহমান বাবু। শুরু বাবুকে দিয়েই। ১৯৮৩ বিশ্বকাপ হেরে যাওয়ার ‘ক্ষতে’ আলতো টোকা দিয়ে মাইক্রোফোন তুলে দিয়েছিলেন গ্রিনিজকে। এরপর? পুরোটা সময় ক্রিকেটপ্রজ্ঞা আর সেন্স অব হিউমারে শ্রোতাদের মুগ্ধ করলেন গ্রিনিজ। যার শুরুটা এমন, ‘কেন ১৯৮৩ বিশ্বকাপ নিয়ে আসা? আমরা কি ১৯৭৫ কিংবা ১৯৭৯ বিশ্বকাপে চোখ রাখতে পারি?...জানি, এটাই টকিং পয়েন্ট।’ একটা পর্যায়ে খেলার চিরন্তন দর্শনটাই নিয়ে এলেন, ‘দিস গেম ইজ গ্রেট লেভেলার।’ ১৯৮৩ তাঁকে আর কষ্ট দেয় না বলেই দাবি গ্রিনিজের।
শুরুতেই বলে নিলেন বাংলাদেশ তাঁর দ্বিতীয় বাড়ি। যে দেশের ক্রিকেটের বড় বাঁকবদলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগ, সে দেশ দ্বিতীয় বাড়ি তো হবেই গ্রিনিজের কাছে। এ বাড়ির অনেক মানুষের সঙ্গে বছরের পর বছর গ্রিনিজের নিবিড় সম্পর্ক আর যোগাযোগ। সেই যোগাযোগের সূত্র ধরেই ঢাকায় আবারও অতিথি হয়ে আসা।
ঢাকায় গ্রিনিজ, অথচ বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে কথা হবে না? নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে গ্রিনিজ যখন বাংলাদেশ দলের কোচ হয়ে এসেছিলেন, তখন বিসিবির ছিল না শক্তিশালী আর্থিক কাঠামো, উন্নত অবকাঠামো কিংবা পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছুই হয়েছে দেশের ক্রিকেটে। কিন্তু বাংলাদেশ গত ২২ বছরে পায়নি প্রত্যাশিত সাফল্য। কেন? গ্রিনিজ প্রশ্নটা নিলেন। উইন্ডিজ কিংবদন্তির কথাটা কিন্তু বিসিবি মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারে, ‘এটা আসল বোর্ডের ব্যাপার যে তারা কীভাবে ক্রিকেটের কাঠামোকে সাজাবে। আপনার অনেক টাকা থাকতে পারে, যদি উন্নয়নে সেটার যথাযথ ব্যবহার না করতে পারেন, সাফল্য প্রত্যাশা অনুযায়ী হবে না। আপনি কী করছেন সেটার ধারাবাহিকতা থাকা দরকার। খেলাটার উন্নয়ন, খেলোয়াড়দের উন্নয়ন, খেলা ও অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধার উন্নয়ন; এরপর খেলোয়াড়দের মানসিকতা তৈরি করা যে তারা ভালো করতে কীভাবে এই সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগাবে। বোর্ডের একটা স্বচ্ছ-দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন, তারা কীভাবে ক্রিকেটে নিজেদের পুনঃসংগঠিত করবে। যদি বাংলাদেশকে ক্রিকেটে শক্তিশালী হতে হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার আগে খেলোয়াড়দের ভালোভাবে তৈরি করতে হবে।’
ক্যারিবীয় কিংবদন্তি বিখ্যাত হয়েছেন আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলেই। কিন্তু এ সময়ের ক্রিকেট যেভাবে সংক্ষিপ্ত হচ্ছে, এটি নিয়ে গ্রিনিজ বেশ বিচলিত, ‘টি-টোয়েন্টি, সর্বশেষ এসেছে ১০ ওভারের ক্রিকেট। জানি না এরপর কী হবে। ২ ওভারের ম্যাচ? সব সময়ই পরিবর্তন হয়। কিন্তু মনে করি না, এটা ভালোর জন্য পরিবর্তন।’ গ্রিনিজের অনুরোধ, ‘দয়া করে খেলাটার সৌন্দর্য নষ্ট করবেন না।’
গ্রিনিজের কাছে টেস্ট ক্রিকেটই আসল ক্রিকেট, যেখানেই দেখা মেলে খেলাটার আসল রোমাঞ্চ, উত্তেজনা। টেস্টেই হয় একজন ক্রিকেটারের আসল পরীক্ষা। ‘কিপ দিজ গেম অ্যালাইভ প্লিজ, আই বেগ ইউ... আমি একজন টেস্ট ম্যাচ সমর্থক, শতভাগ’—গ্রিনিজের এ আর্তি ভরা কণ্ঠ যেকোনো ক্রিকেট রোমান্টিকের মন হু হু করে উঠতে বাধ্য।