১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির সময় আমার বয়স চার থেকে পাঁচ ছুঁইছুঁই করছে। তখনই আমার দাঁতের ব্যথার শুরু। ছিলাম মায়ের কোলে ক্রন্দনরত। একুশে ফেব্রুয়ারির কেন্দ্রস্থল থেকে বহুদূরে প্রায় ৭০ মাইল সে-ও দুর্গম গ্রাম। টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা আসার সরাসরি কোনো যান ছিল না। আসতে হতো ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকায়। মা আমার কান্নাটা কমাতে গ্রামের পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরেছেন। এরই মধ্যে একটা শোরগোল শুনতে পেলাম স্কুলঘরের দিকে। সেখানে গিয়ে কিছু যুবকের কণ্ঠে শুনলাম স্লোগান, ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’, ‘নুরুল আমিনের কল্লা চাই’। ওই বয়সে এই সব কথার কোনো অর্থ আমার বোঝার কথা নয়। কিন্তু আজকে প্রায় সত্তর বছর পরেও সেই স্লোগানগুলো কানে বাজে। সেই বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন একটা বড় ব্যাপার হয়ে গেল।
আমরা বাংলা ভাষায় লেখাপড়া করতে পেরেছি। কিন্তু শক্তিশালী শাসকগোষ্ঠী সেই সময়ে উর্দুকেও একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয় হিসেবে পাঠদানে যুক্ত করে দিল। উর্দুকে যেহেতু শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষা করে দিয়েছিল, তাই কেমন যেন একটা বিজাতীয় ভাবনা মনে করে খুব অবহেলা করেছি। অথচ উর্দু একটি সাহিত্যসমৃদ্ধ ভাষা। পরবর্তীকালে কৃষণ চন্দর, সাদাত হাসান মান্টো আমাদের প্রিয় সাহিত্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। মির্জা গালিবের গজল এখন প্রায় প্রতিদিনের সুখশ্রাব্য।
কিন্তু ইংরেজিকে আবার সাদরে গ্রহণ করেছি। কারণ পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যোগাযোগের উপায় এবং রাষ্ট্রভাষা মূলত ইংরেজিই হয়ে দাঁড়ায় এবং মধ্যবিত্তদের মধ্যে ইংরেজি সাহিত্য ও সংস্কৃতি একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সৌভাগ্য, পাকিস্তানিদের নব্য উপনিবেশ ষড়যন্ত্র সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই আমাদের নেতারা বুঝেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৮ সালে ওদের চূড়ান্ত চেহারাটা দেখা গেল। কিন্তু ওই যে বায়ান্ন সালের একটা বিজয় আছে, তাই আমাদের আন্দোলন থামল না। নেতা আর কর্মীদের সেই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের সঙ্গে ছিল ছাত্ররা। কারণ, নানা ধরনের শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখা হয়েছিল।
পুরো ষাটের দশকেই আন্দোলন-সংগ্রাম, সেই সঙ্গে ভাষার চর্চা। ওই সময়ে কবিদের একটা উত্থান ঘটে। জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের সঙ্গে শিশুসাহিত্যের যোগাযোগ মানুষকে একটা স্বপ্নের কাছাকাছি দাঁড় করায়। সেই স্বপ্নের ফলাফলই উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতা এনে দিল। রাষ্ট্রভাষা হলো বাংলা। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার উদ্যোগ শুরু হলো।
তারপর ৫০ বছর পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে পদ্মা, মেঘনা, যমুনায় অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। সামরিক শাসন এসেছে। গণতন্ত্রের জন্য লড়াই হয়েছে। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা এর মধ্যে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ইংরেজি স্কুল এসেছে, মাদ্রাসা এসেছে। স্কুলঘরগুলো দালান হয়েছে। আবার তা ভেঙেও পড়েছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসের আস্তানা হয়েছে; কিন্তু প্রকৃত শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃত বাঙালি ও বাংলা ভাষাও নির্বাসনে গেছে। বাংলা ভাষার জন্য আমাদের প্রেম শুধু ফেব্রুয়ারিতে। এ মাসেই বই কেনে বাঙালি, সারা বছর আর কেনে না। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষার জন্য আবেগ উথলে ওঠে। কিন্তু সারা বছর তা আর থাকে না। আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেও একুশে ফেব্রুয়ারি মানেই নতুন একটা সংকলন বেরোবে, যেখান থেকে কিছু না কিছু সাহিত্যিকের জন্ম হবে। গত বছরগুলোতে সেই সব সৃজনশীল কর্মকাণ্ড আর দেখা যায় না।
একদা রাত বারোটায় পশ্চিমা নিয়মানুসারে কিছু হতো না। একুশের অনুষ্ঠান শুরু হতো প্রভাতফেরি দিয়ে। নগ্ন পায়ে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে যে যার পাড়া-মহল্লায় ফিরে যেত। তারপর শুরু হতো একুশের অনুষ্ঠানমালা। একটা রুচিহীন বিষয় শুরু হয়েছিল একসময়, তা হলো কে বা কোন দল আগে শহীদ মিনারে ফুল দিতে পারে। বেশ অনেক বছর যাবৎ তা চলে গেছে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে। তরুণসমাজের কাছে যদি একুশের তাৎপর্য বোঝানো যেত, তাহলে হয়তো বর্তমানের তারুণ্যের উপদ্রব কমতে পারত। যদিও বড়রা সব জেনেশুনেও দেশটাকে লুটপাট করে লোপাট করে দিচ্ছে।
একবার অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে এবং নিউইয়র্কে বহুবার দ্বিতীয় প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছি। ঠিক আলোচনা নয়, গল্প করার জন্য। একপর্যায়ে পশ্চিমা সাহিত্য, বাংলা সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে শুরু করি। আমাদের সাহিত্যের ভান্ডার যে এত বড়, তা তারা জানে না। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ছাড়াও সাহিত্যিক আছেন বাংলা ভাষায়, যাঁরা নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। কিছু গান, কিছু কবিতা মুখে মুখে অনুবাদ করেও শোনালাম। এতেই শিশু-কিশোরেরা আগ্রহী হলো যে ওদের বাবা-মা দেশে এলে বাংলা সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে যেতে।
এ দেশে থেকেও অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের বাংলা সাহিত্যে পড়ান না। ফলে ‘এ লেভেল’, ‘ও লেভেল’ দেওয়া ছেলেটা বাংলার প্রতি কোনো আগ্রহ বোধ করে না। সেই সঙ্গে সে বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি এবং স্বদেশের প্রতিও কৌতূহল বোধ করে না। এমনি করেই বাংলার কোল থেকে শিশুরা হারিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমান ইন্টারনেটের আগ্রাসনে সর্বক্ষণ শুধু শিশু-কিশোর নয়, তাদের অভিভাবকেরাও ব্যস্ত। সবাই যেন নির্বাক চলচ্চিত্রের একেকজন চরিত্র। একটা সময় ছিল যখন বাংলার বাড়িগুলো ছিল সব মানুষের কথায় মুখর। শহর-গ্রাম সর্বত্রই মানুষের কলতানে একটা সুন্দর সমাজ গড়ে উঠত।
একুশের ভোর। তখন ছিল সারা বছরের অপেক্ষার একটা প্রহর। হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত একটা ভালোবাসার নৈবেদ্য। ভাষার প্রতি ভালোবাসাই মহৎ কোনো কর্মে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে; শুধু সাহিত্য নয়, জীবনের সর্বত্র। আমাদের বাঙালিদের একটা দুর্নাম আছে—আমরা যাকে বিশ্বাস করি, তাকে ভক্তি করি না। অবশ্য এটা সুনির্দিষ্ট অর্থে বাঙালি মুসলমানদের ক্ষেত্রে খাটে। আমরা যে গ্রহে বাস করি তার চারপাশটাকে সুন্দর করে ফুলে ফুলে সজ্জিত করি না। যারা ধর্মকে বিশ্বাস করে, তারা ধর্মের অনুশাসন মানে না। সত্য বলার প্রতিশ্রুতি তারা বারবার ভাঙে। যে ভাষার কথা বলতে গিয়ে আমাদের রাজনীতিকেরা বারবার গলা ভাঙেন, তাঁরা একুশের চেতনা কেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও কি ধারণ করেন? তাঁরা বাংলায় লেখাপড়া করেছেন, কিন্তু তাঁদের সন্তানেরা কি এ দেশে বাংলায় পড়ছে? দেশে লুটপাট করে আমলা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিকেরা ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়িয়ে ওখানেই বাড়িঘর করে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবেন।
বাংলা ভাষার দুঃখ তাই কমল না। বিশ্বাস আর ভক্তি যদি এক জায়গায় না মেলে আর অঙ্গীকার যদি যুক্ত না হয়, তাহলে বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ কারও দুঃখই কমবে না।
লেখক: মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব