রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটু আগ্রহ আছে যাঁর, তিনি জানেন ১৮৯১ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত সময়টিতে রবীন্দ্রনাথ স্থায়ীভাবে পূর্ববঙ্গে বাস করেছিলেন। অনেকেই খেয়াল করে দেখেছেন, দীর্ঘ ৮০ বছরের জীবনে রবীন্দ্রনাথের এই পূর্ববঙ্গ বসবাসের সময়টাই সবচেয়ে বেশি সৃষ্টিশীল।
কী করে এ সময় তিনি এতটা সৃষ্টিশীল হয়ে উঠলেন? পূর্ববঙ্গে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রবীন্দ্রনাথকে ঋদ্ধ করেছিল। আগে তিনি যেন বাস করতেন বদ্ধ জলাশয়ে, এখানে এসে পেলেন প্রমত্তা নদী।
একসময় তিনি ইতিহাসের চরিত্রদের নির্মাণ করেছেন সাহিত্যে। তাঁর লেখায় এসেছে কবি পৃথ্বীরাজ, মোহাম্মদ ঘোরী, প্রতাপাদিত্য, গোবিন্দমাণিক্য। পূর্ববঙ্গে এসে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন সাধারণ মানুষকে নিয়ে। তাঁর লেখায় উঠে এল এক দরিদ্র পোস্টমাস্টারের কথা। রতনের কথা। পূর্ববঙ্গের প্রকৃতিও মুক্তি পেল রবীন্দ্রনাথের লেখায়। প্রকৃতিই যেন তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছিল। ছিন্নপত্রাবলীতে তিনি লিখেছেন, ‘আমিও লিখছিলুম এবং আমার চারপাশে আলো এবং বাতাস এবং তরুশাখার কম্পন তাদের ভাষা যোগ করে দিচ্ছিল।’
রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টার গল্পটিতে যে পোস্টমাস্টারের কথা বলা হচ্ছে, তাঁর দেখা পেয়েছিলেন তিনি শাহজাদপুরে, ছুটি গল্পের ফটিককেও। ছিদাম, মৃন্ময়ীরাও তো পূর্ববঙ্গের জমিদারিতেই বাস্তবে-কল্পনায় মিশে ছিল। আর কবিতা? এই সময়টিতে রবীন্দ্রনাথ কবিতা লিখেছেন পাঁচ শরও বেশি। সোনার তরী আর চিত্রা কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই পূর্ববঙ্গে বসে লেখা। বৈষ্ণব ও বাউল—এই দুই লৌকিক ধর্মেও আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি। পূর্ববঙ্গ পর্বে বাউলেরা তাঁর ওপর প্রভাব ফেলেছিল। প্রথম যে বাউল গানটি রবীন্দ্রনাথের মনকে নাড়া দিয়েছিল, সেটি হলো, ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে...’। বাউল দর্শন ও গানের সুর রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করে শান্তিনিকেতনে স্থায়ী বসবাসের সময়ই বাউল প্রভাব পড়ে রবীন্দ্রনাথের রচনায়।
বাউল-দর্শন রবীন্দ্রনাথকে আলোড়িত করেছিল গীতাঞ্জলি রচনার সময়।
সূত্র: গোলাম মুরশিদ, রবীন্দ্রমানস ও সৃষ্টিকর্মে পূর্ববঙ্গ, পৃষ্ঠা ৯৬-১২০