দেশের রাজনীতিতে দৃশ্যমান কোনো অস্থিরতা নেই। আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। দীর্ঘদিন একটি দল ক্ষমতায় থাকলে মানুষের মনে একধরনের অবসাদ তৈরি হয়। আমাদের দেশে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর একবার এক দল, পরেরবার আরেক দল ক্ষমতায় যাওয়ার একটি রেওয়াজ চালু হচ্ছিল। সেটা ভালো না খারাপ, সে আলোচনা আজ নয়। কিন্তু এক দলের পর আরেক দল, এ ক্ষেত্রে বিএনপির পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার রীতিটা ভেঙে গেছে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর। ২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সরকার পতনের কথা বলে আসছে, কিন্তু সেটা শুধু যেন বলার জন্যই বলা। মানুষকে সংগঠিত করে বড় কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না। মানুষ আন্দোলন পছন্দ করছে না। মানুষ কি তাহলে স্থিতাবস্থার পক্ষে? মানুষের জীবনে কি কোনো সমস্যা নেই, নেই কোনো দুঃখ-কষ্ট?
মানুষের সমস্যা আছে। দুঃখ-কষ্টও আছে। তারপরও কেন দেশে সরকারবিরোধী গণ-আন্দোলনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না? এটা কি কেবল সরকারের সাফল্যের জন্য, নাকি এর জন্য বিরোধী দলের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দুর্বলতাও দায়ী। সরকারের সাফল্য এবং বিরোধী দলের দুর্বলতা মিলিয়েই দেশে রাজনীতিতে স্বস্তি বিরাজ করছে বলে মনে হয়। তবে এর মধ্যেও দু-একটা ঘটনা ঘটছে, যা সরকারকে বিব্রত করছে।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে গত বুধবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য সবাইকে আশার কথাই শুনিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, কয়েক মাস পরেই চালু হতে যাচ্ছে বহুল কাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু। এই সেতু জিডিপিতে ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। চলতি বছরের শেষের দিকে রাজধানীর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার অংশে মেট্রোরেল চালু হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আশা করা যায়, মেট্রোরেল রাজধানী ঢাকার পরিবহনব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। আগামী অক্টোবর মাসে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে চালু হবে
দেশের প্রথম টানেল।’
আগামী বছরের শেষ নাগাদ দেশের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রথম ইউনিট চালু করার কথা জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘গত মাসে পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন অত্যাধুনিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্ধারিত সময়ের আগেই উদ্বোধন করা হয়েছে। অন্য মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।’
শ্রীলঙ্কায় সম্প্রতি যে গভীর অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে কারও কারও বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও সংকটের আশঙ্কা প্রকাশ করার প্রসঙ্গ তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে, কোনো ঋণ নেওয়া হয়নি। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দ্বারা অর্থনৈতিক সমীক্ষার মাধ্যমে আমরা অন্যান্য মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছি।’ শুধু ঋণ নয়, বিদেশি অংশীদারত্বের ভিত্তিতে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আমাদের অর্থনীতির চেহারা বদলে যাবে। আমরা দেশি-বিদেশি ঋণ নিচ্ছি। তবে তা যাতে বোঝা হয়ে না ওঠে, সেদিকে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে।’
দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যে হারে বাড়ছে, সে হারে মানুষের আয় বাড়ছে না। কম আয়ের মানুষেরা, কর্মহীন মানুষেরা কষ্টে আছে। সরকার টিসিবির মাধ্যমে কিছুটা সাশ্রয়ী মূল্যে চাল-ডাল-তেল সরবরাহের উদ্যোগ নিলেও তা চাহিদার তুলনায় কম। সাশ্রয়ী দামে পণ্য কেনার জন্য টিসিবির দোকানে মানুষ ভিড় করবে—এটাকে স্বাভাবিক বলে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দামে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে পণ্য পরিবহনে ভাড়া ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে দেশেও কিছু কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। আমরা কিন্তু চুপচাপ বসে নেই। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে স্বস্তি নিয়ে আসার।’ দেশে চালসহ কোনো পণ্যের ঘাটতি নেই বলে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগ শাসনামলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি-সমৃদ্ধি ঘটলেও ‘ধর্মীয় বিভেদমুক্ত দেশ গড়া’য় কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তা নিয়ে অনেকের মনেই সংশয় ও প্রশ্ন আছে। সম্প্রতি একজন বিজ্ঞান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে কারাবাস, টিপ পরা, হিজাব পরা নিয়ে কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে ইতিহাসবিদ ও লেখক ড. মুনতাসীর মামুন লিখেছেন: ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে অর্জন করেছেন, দেশের যে ইমেজ তৈরি করেছেন তার সঙ্গে এগুলো যায় না। মনে হবে আমরা এখনো “মধ্য যুগে” বসবাস করছি। এসব ঘটনায় জড়িত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ, আনসার, আমলা, এমনকি শিক্ষকও। গত কয়েক বছর কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করার আমার সুযোগ হয়েছে। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, যুগ্ম সচিব পর্যায় পর্যন্ত অধিকাংশ, মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত কোনো কাজ হলে তাতে যত রকম বাধা সৃষ্টি করা যায় করেন। শুনেছি, সত্য না-ও হতে পারে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে ইনকিলাবের ঢাবির একসময়ের রিপোর্টার ও শিবির কর্মী একজন কর্মকর্তা। প্রশাসনের একটি বড় অংশে এরা এখন নিশ্চুপ সংখ্যাগরিষ্ঠ। ঠিক সময়ে যারা উঠে দাঁড়াবে।’
এ জন্যই কি দেশে ধারাবাহিকভাবে মিথ্যা অভিযোগ তুলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার অপচেষ্টা চলেছে? রামুতে উত্তম বড়ুয়া, নাসিরনগরে রসরাজ, ভোলায় বিপ্লব বৈদ্য, গঙ্গাচড়ায় টিটু রায়, বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল, নওগাঁয় আমোদিনী পালকে ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত দেওয়ার মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিয়ে উন্মত্ততা, উন্মাদনা ছড়ানোর ঘটনাগুলো কি প্রত্যাশিত ছিল? মিথ্যা রটিয়ে, গুজব ছড়িয়ে শান্তি-সম্প্রীতি বিনষ্ট করার দায়ে কেন একজনকেও শাস্তি দেওয়া গেল না? কোথায় দুর্বলতা, কার দুর্বলতা? স্বার্থ, সুবিধা, সাম্প্রদায়িকতা যে হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে, তা বোঝার জন্য কি বড় কোনো গবেষণার প্রয়োজন আছে? কিছু সময়ের বিরতি দিয়ে ঘটনাগুলো ঘটছে, অনবরত ঘটছে। কিন্তু প্রতিকার হচ্ছে না।
ক্ষতিকর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক-বাহক বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতা থেকে দূরে আছে প্রায় ১৬ বছর। সম্প্রতি টঙ্গী এলাকার কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে জরিপ চালিয়ে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তা হতাশাজনক। আমাদের শিক্ষার্থীরা দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে কিছুই জানে না। একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম বলতে পারে না, স্মৃতিসৌধ ও শহীদ মিনারের পার্থক্য বোঝে না, জাতীয় চার নেতার নাম জানে না, স্বাধীনতাবিরোধীদের সম্পর্কে কিছুই বলতে পারে না—এমন প্রজন্ম দেশকে কোন উচ্চতায় নেবে?
তাই এখন বাহ্যিক রাজনৈতিক শান্তি দেখে প্রশান্তি লাভের চেষ্টা না করে সমাজে-রাষ্ট্রে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জরুরি কিছু বিষয়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার। যেহেতু দেশের অনেক মানুষের সব আশা-ভরসার কেন্দ্রস্থল এখনো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তিনি ও আওয়ামী লীগ যেহেতু অবিভাজ্য, সেহেতু তাঁর সঙ্গে তাল মেলানোর উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে আওয়ামী লীগকে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে তিনি সব দিক থেকেই আওয়ামী লীগের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। দলের মধ্যে চিন্তার ঐক্য না থাকলে এগিয়ে চলা কঠিন। অর্থনৈতিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের উচ্চ নৈতিকতারও অধিকারী হওয়া প্রয়োজন। নৈতিকতার চরম অবক্ষয় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ম্লান করে দিতে পারে।
প্রসঙ্গত, আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক হিসেবে পরিচিত লি কুয়ান সরকার ও দল পরিচালনার জন্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতে যেসব উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা উল্লেখ করা যেতে পারে। দেশ এবং বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষিত মেধাবীদের যোগ্যতার ভিত্তিতে তিনি নির্বাচিত করেছিলেন এবং তারা পার্টিতে যোগদানের তিন-চার বছরের মাথায় গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করতেন। লি কুয়ান লিখেছেন, ‘আমি মনে করতাম নতুন জমানার মেধাবী ছেলেদের অপেক্ষা করার মতো অবকাশ নেই। পার্টিতে রাখতে হলে তাদের যথাযথ সুযোগ করে দিতে হবে। না হলে ওরা ওদের পছন্দের পথে চলে যাবে।’
এককথায় বলা যায়, সিঙ্গাপুরের যোগ্য উত্তরসূরি প্রশাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে লি কুয়ান কিছুটা ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তবে উত্তরাধিকার নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি যোগ্যতরজনকে খুঁজতে কড়া ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করতেন।
রাষ্ট্রীয় বা সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে লি কুয়ান ও তাঁর সরকার আস্থা রেখেছিল ‘ধান্ধাবাজিতে অভ্যস্ত নয়, কিন্তু মেধাবী, আন্তরিক, কর্মদক্ষ এবং গতিশীল তরুণ’ কর্মকর্তাদের ওপর।
লি কুয়ান লিখেছেন, ‘নবনিযুক্তদের জন্য রাজনৈতিক সচেতনতা এবং তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততার গুণাগুণ অর্জন করাটা ছিল অত্যাবশ্যক। যাঁদের ভেতর এসব অতিরিক্ত গুণাবলি দেখা যেত, আমি শুধু তাঁদেরই মন্ত্রিসভায় স্থান করে দিতাম।’
লি কুয়ান নিজেও নতুনদের জন্য তাঁর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। ১৯৯০ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়েন। অবশ্য এরপরও তিনি সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। লি কুয়ান লিখেছেন, ‘আমি ৩১ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলাম। ইচ্ছা করলে আরও এক টার্ম ওই পদে বহাল থাকতে পারতাম। কিন্তু তাতে আমার সক্ষমতা ও কার্যক্ষমতা প্রমাণ করা ছাড়া আর তেমন কিছুই অর্জিত হতো না। অন্যদিকে, দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে আমি যদি আমার উত্তরসূরিদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারি, তাহলে সেটা সিঙ্গাপুরের জন্য অধিকতর কল্যাণকর হবে। এ ধরনের চিন্তাভাবনা থেকেই আমি আর প্রধানমন্ত্রীর পদ ধরে রাখিনি।’