হোম > ছাপা সংস্করণ

হাদিসুরের মৃত্যু ও আমাদের দায়

শরিফুল হাসান

৯ মার্চ বুধবার দুপুর। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেছেন এমভি বাংলার সমৃদ্ধির ২৮ জন নাবিক। রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর নানা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় ইউক্রেনের সাগরে দুই সপ্তাহ থাকার পর নিরাপদে দেশে ফিরতে পারায় স্বস্তিতে তাঁরা। খুশি তাঁদের স্বজনেরা। ঠিক একই সময়ে বিমানবন্দরে ছেলের লাশের অপেক্ষায় কাঁদছেন আবদুর রাজ্জাক হাওলাদার ও রাশিদা বেগম দম্পতি। তাঁদের বড় ছেলে হাদিসুর রহমানের লাশের অপেক্ষা করছেন তাঁরা। অথচ একই সঙ্গে হাদিসুরও ফিরতে পারতেন। কিন্তু কেন মরতে হলো হাদিসুরকে?

হাদিসুর বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির ৪৭তম ব্যাচের ক্যাডেট ছিলেন। তাঁর ব্যাচমেট আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ তিন দিন আগে লিখেছেন, ‘কী দোষ ছিল হাদিসের? জেনেশুনে তাঁদের একটা বিপজ্জনক স্থানে পাঠানো হলো। বিপদে সাহায্য চাওয়ার এক সপ্তাহ পরেও ২৯টা জীবন নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্বেগ হলো না? হাদিসকে মেরে ফেলার পর যে সিদ্ধান্ত ২৪ ঘণ্টার কম সময়ে নেওয়া গেল, ঘটনার আগের ৭ দিন আপনারা কেন পারলেন না, কেন নিলেন না? লাশ ছাড়া কি কোনো যৌক্তিক দাবিও বাস্তবায়ন হয় না এখানে? হাদিসকে জীবন দিয়ে কেন বাকি ২৮ জনকে বাঁচাতে হলো? কেন তাঁদের আহাজারি কর্তৃপক্ষের কর্ণকুহরে আগে পৌঁছায়নি?’

এসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার উত্তেজনা তো ফেব্রুয়ারিতে চরমেই। এর মধ্যেই ২২ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনের দুটি অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিল। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই বাংলাদেশি জাহাজ এমভি বাংলার সমৃদ্ধিকে কেন পণ্য পরিবহনের জন্য পাঠানো হলো ইউক্রেনে? যুদ্ধাবস্থা চলছে—এমন এলাকায় জাহাজ না পাঠানোর এখতিয়ার জাহাজমালিক হিসেবে বিএসসির ছিল। তারা সেটি কেন করল না? বিশেষত যুদ্ধ শুরুর পর নাবিকেরা যখন তাঁদের ‍উদ্বেগের কথা জানাচ্ছিলেন, তখনো কেন ব্যবস্থা নেওয়া হলো না?

২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরের অদূরে নোঙর করে জাহাজটি। রাত না পেরোতেই পরদিন ভোরে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরু হয়। এর পর থেকেই জাহাজের নাবিকেরা দেশে যোগাযোগ শুরু করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে একাধিক খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু উদ্ধারের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

২৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো সংবাদ প্রকাশ করে ইউক্রেনে আটকা পড়েছে বাংলাদেশি জাহাজ। পরদিন প্রথম আলো আরেকটি সংবাদ প্রকাশ করে, যার শিরোনাম, ‘বোমার আতঙ্কে দিনরাত কাটছে এমভি বাংলার নাবিকদের’। ওই খবরে নাবিকদের উদ্ধারে পদক্ষেপ নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) নির্বাহী পরিচালক (বাণিজ্য) পীযূষ দত্ত আগের দিনের মতোই বলেন, ‘জাহাজটি এখন যেখানে আছে, সেখানে এ মুহূর্তে সবচেয়ে নিরাপদ।’ (২৮ ফেব্রুয়ারি, প্রথম আলো)

আচ্ছা কিসের ভিত্তিতে শিপিং করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলেছিলেন নাবিকেরা নিরাপদ? দেখেন পরদিন, ২ মার্চ বুধবার স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত ৯টার দিকে) গোলার আঘাতে জাহাজটিতে আগুন ধরে গেল, প্রাণ হারালেন থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান। জাহাজের ২৮ নাবিক এরপর বারবার তাঁদের জাহাজ থেকে নামিয়ে নেওয়ার আকুতি জানাতে থাকেন।

হামলার ২৪ ঘণ্টার মাথায় ৩ মার্চ ইউক্রেনপ্রবাসী বাংলাদেশিদের সহায়তায় নাবিকদের একটি টাগবোটে করে বন্দরের বাইরে একটি বাংকারে নেওয়া হয়। ওই বাংকারে ৩৯ ঘণ্টা কাটানোর পর ৫ মার্চ বাংলাদেশ সময় দুপুর সোয়া ১২টার দিকে নাবিকেরা একটি বাসে করে প্রতিবেশী দেশ মলদোভা সীমান্তের উদ্দেশে রওনা দেন। এরপর মলদোভার সীমান্ত থেকে তাঁরা রোমানিয়ার উদ্দেশে রওনা হন এবং সেখান থেকে ঢাকা।

ইউক্রেনের প্রবাসী বাংলাদেশি ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেন বাণিজ্যিক জাহাজের নাবিকদের সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সভাপতি ক্যাপ্টেন মো. আনাম চৌধুরী। তিনি গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘ওই বন্দরের আশপাশের এলাকায় বসবাসকারী বাংলাদেশি কয়েকজন নাগরিক পূর্বপরিচয়ের সূত্রে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। তখন আমি দ্রুততম সময়ে ডিজি শিপিংয়ের সঙ্গে কথা বলে ওনাকে বিষয়টি জানাই। এরপর সেই ইউক্রেনপ্রবাসীরা ডিজি শিপিংয়ের মাধ্যমে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন।’

প্রশ্ন হলো, ২৩ ফেব্রুয়ারি জাহাজটি যেদিন বন্দরে আটকা পড়েছিল, সেদিনই নাবিকদের উদ্ধারের চেষ্টা করা যেত কি না? এই যে হাদিসুরের মৃত্যুর পর যেভাবে আমরা তৎপর হলাম, সেটি আরেকটু আগে করা যেত কি না? বিষয়গুলো নিয়ে তদন্ত জরুরি। হাদিসুরকে তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না; কিন্তু এই ঘটনা থেকে আমরা যেন শিক্ষা নিই, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো হাদিসুরকে মরতে না হয়।

হাদিসুরের মরদেহ দেশে আনার চেষ্টা চলছে। এমন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে লাশ আনাটা খুব সহজ কাজ নয়। আবার ইউক্রেনে বেঁচে থাকা মানুষদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার কাজটিও ‍চলছে। অবশ্য ইউক্রেনে এখন কতজন আটকা পড়া বাংলাদেশি রয়েছেন, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।

রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করার পরপরই ইউক্রেনে বসবাসরত বিশ্বে বিভিন্ন দেশের নাগরিকেরা পোল্যান্ডে প্রবেশের চেষ্টা করেন। সেখানে মানবেতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি পোল্যান্ডের বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে জানানো হয়, পোল্যান্ড-ইউক্রেন সীমান্ত প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা ছাড়া উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বৈধ পাসপোর্টধারীরা সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে পাসপোর্ট প্রদর্শন করে পোল্যান্ডে ঢুকতে পারবেন। যাঁদের পাসপোর্ট নেই, তাঁরা ট্রাভেল পাস নিয়ে ঢুকতে পারবেন।

ইউক্রেনে হাজার দেড়েক বাংলাদেশি থাকেন। অধিকাংশ বাংলাদেশি ইউক্রেন থেকে সরে এসেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এখনো কিছু মানুষ ব্যবসা-চাকরি-গাড়ি-সংসার—সবকিছু ছেড়ে আসা নিয়ে দ্বিধায় আছেন। যেকোনো সময় যেন তাঁদের উদ্ধার করা যায় সে ব্যবস্থা থাকা উচিত। আবার কেউ হয়তো কোথাও আটকে আছেন যে তথ্য হয়তো দেশে থাকা তাঁদের স্বজনেরা জানেন। কাজেই ইউক্রেনে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের তথ্য জানার জন্য দেশেও একটা হটলাইন চালু করা যেতে পারে।

যুদ্ধের এমন পরিস্থিতি তো নতুন নয়। বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ১৯৯০ সালে ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের সময় ৭২ হাজার বাংলাদেশিকে ফেরত আনা হয়েছে। ২০১১ সালে লিবিয়া যুদ্ধের পর ৩৭ হাজার বাংলাদেশিকে ফেরত আনা হয়েছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ইউক্রেনে থাকা বাংলাদেশিদেরও উদ্ধার করা সম্ভব। শুধু সম্ভব নয় যারা মরে যাবে তাদের ফিরিয়ে আনা।

রাশিয়া যে রাতে ইউক্রেনে হামলা করল সেই রাতে জেগে জেগে ফের শিন্ডলার্স লিস্ট সিনেমাটা দেখেছি। যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন সিনেমার কাহিনি দারুণ মানবিক। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছেন অস্কার শিন্ডলার নামের এক জার্মান ব্যবসায়ী, যিনি নাৎসি বাহিনীতে যোগ দিয়ে পোল্যান্ডে এসেছেন ‘যুদ্ধের সুবিধা’ কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হতে।

শিন্ডলার নাৎসি এসএস বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে এবং তাদের প্রচুর টাকা ঘুষ দিয়ে পোল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তর শহর ক্রাকাউয়ে তিনি একটি কারখানা তৈরি করেন। এরপর ওই কারখানায় কাজের জন্য ইহুদিদের নেন এই উদ্দেশ্যে যে তারা সস্তায় শ্রম দেবে। কিন্তু একদিন কারখানায় নিয়োগ পাওয়া এক হাতওয়ালা এক বৃদ্ধ ইহুদি এসে শিন্ডলারের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কারখানায় নিয়োগ দিয়ে জার্মান বাহিনীর অত্যাচার থেকে তাকে বাঁচানোর জন্য।

এরপর শিন্ডলার নানা উপায়ে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে ইহুদি শ্রমিক সংগ্রহ করে তাঁর কারখানায় নিয়োগ দিতে শুরু করেন, যাতে করে তারা বেঁচে যায়। নিজের সব টাকা দিয়ে শিন্ডলার তার সহকারী স্টার্নকে নিয়ে ১ হাজার ১০০ জনের একটি তালিকা তৈরি করে। এই তালিকা শিন্ডলার্স লিস্ট বা শিন্ডলারের তালিকা নামে পরিচিত। এই তালিকার সবাই বেঁচে যায় এবং তারা যুদ্ধের শেষে একটা সোনার আংটি শিন্ডলারের হাতে তুলে দেয়, যাতে হিব্রু ভাষায় লেখা ‘যিনি একজনের জীবন বাঁচান, তিনি সমস্ত পৃথিবীকে বাঁচান’।

আফসোস সেই আমরা যখন যুদ্ধের নামে, সংঘাতের নামে, স্বার্থের নামে মানুষ হত্যা করি। চলুন, সবাই যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। এই পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য মানবতা ও ভালোবাসার কোনো বিকল্প নেই। কাজেই যুদ্ধ নয়, মানবতার জয় হোক!

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ