চাকরিপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ভাইভা বা ইন্টারভিউ। ইন্টারভিউ নিয়ে রসপরিহাসভরা সিনেমা-নাটক-সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে অনেক। ইন্টারভিউর নামে কখনো হয় স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা, কখনো হয় নিষ্ঠুর রসিকতা। ইন্টারভিউয়ে এসে অসংখ্য চাকরিপ্রার্থীর আশা-ভরসা উবে যায়।
ভাইভার নামে যা হয় তার একটি রসঘন বর্ণনা পাওয়া যায় কথাশিল্পী সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘ইন্টারভ্যু’ নামক রম্যরচনায়। ফারসি ভাষার শিক্ষক নিয়োগের সেই ভাইভা বোর্ডের অন্যতম সদস্য ছিলেন মুজতবা আলী নিজে। প্রার্থীদের ফারসিজ্ঞান পরখের বদলে বোর্ড সদস্যরা নিজেদের ইংরেজি সাহিত্যের পাণ্ডিত্য ফলাতে অবান্তর সব প্রশ্নের অবতারণা করতে থাকেন। বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রার্থীদের জব্দ করতে পকেটে রাখা একটি চিরকুট ধরিয়ে দেন এবং সেটাতে লেখা বিদঘুটে একটি কবিতাংশের অর্থোদ্ধার করতে বলেন। কবিতার মর্মোদ্ধার তো দূরের কথা, সরলপাঠেই প্রার্থীদের ত্রাহি অবস্থা হয়ে যায়।
আসলে চেয়ারম্যান সাহেবের ছিল পছন্দের এক প্রার্থী। তিনি সবাইকে জব্দ করেছিলেন যে কবিতা দিয়ে, সেটির ওপর পূর্বাহ্ণেই জোর তালিম দিয়ে এসেছিলেন নিজের পছন্দের প্রার্থীকে। ফলে সেই দুর্বোধ্য কবিতার লাইনগুলো শেখানো বুলির মতো হড়বড় করে আওড়ে যান সেই প্রার্থী। বোর্ড সদস্যদের অবশ্য সেই প্রার্থীর পারঙ্গমতার রহস্যভেদ করতে অসুবিধা হয়নি। ইন্টারভিউয়ের নামে প্রহসন আর প্রার্থীদের হেনস্তা দেখে বিরক্ত হয়ে লেখক সেদিন মনে মনে বলেছিলেন, ‘মারো ঝাড়ু, স্লা নোকরি ওর উসকি ইন্টারভ্যু পর।’
সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো এমন কথা আমি নিজেও বলেছিলাম বিসিএস পরীক্ষার ভাইভা দেওয়ার পর। ভাইভার সেই অভিজ্ঞতা আমি জীবনেও ভুলব না।
জীবনের প্রথম কোনো চাকরির ভাইভায় অবতীর্ণ হয়েছি। সরকারি কলেজে অধ্যাপনার চাকরি। তাই আমার মনঃসংযোগ নিবদ্ধ ছিল বাংলায়। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমি ছিলাম বিবাহিত ও মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের। উচ্চশিক্ষা নিয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে থেকে সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়েছিলাম। ভাইভা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, যিনি ছিলেন পিএসসির সদস্যও। বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল।
সালামপর্ব শেষ হলে মুখ খুললেন চেয়ারম্যান সাহেব নিজে। কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় পড়াশোনা করেছ, আনন্দমোহনে?’
প্রশ্নটি নয়, প্রশ্নে মিশে থাকা তাচ্ছিল্যের সুরটা আমার আত্মসম্মানে নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আত্মশ্লাঘায় ভীষণভাবে আঘাত করল।
চেয়ারম্যান সাহেবের চোখে চোখ রেখে দৃঢ় গলায় বললাম, ‘সার্টিফিকেট দেখুন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।’ বোর্ডের অন্যতম একজন সদস্যকে দেখিয়ে বললাম, ‘আমি স্যারের ছাত্র।’
এবার তিনি টিটকারির মতো করে বলে উঠলেন, ‘ও, তুমি তো আবার বিবাহিত। প্রেমট্রেম করে বিয়ে করেছ নাকি? কী, শ্বশুরের টাকায় পড়াশোনা করেছ নাকি?’
আমি আত্মবিশ্বাস নিয়ে উত্তর দিলাম, ‘স্যার, শুধু বিবাহিত নই, আমার ছেলে স্কুলে যায়। শ্বশুরপক্ষের দেওয়া আংটি পর্যন্ত হাতে পরিনি। নিজের উপার্জনে আমি এমএ পাস করেছি, আমার স্ত্রীকেও এমএ পাস করিয়েছি।’
বিয়ের প্রসঙ্গটি টেনে তিনি বারবার কথা ঘোরালেন। আমি সত্য-মিথ্যার মিশেলে গল্প ফেঁদে উতরে যেতে চেষ্টা করলাম। এরপর তিনি আমার উপার্জনের উপায়, অর্থাৎ সাংবাদিকতা পেশার বিষয়ে খোঁজখবর নিতে গিয়ে নিশ্চিত হতে চাইলেন একটি বিশেষ পত্রিকায় কাজ করেছি কি না, নিদেনপক্ষে সেই পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ আছে কি না। এরপর তিনি আমার হাতে মার্কার পেন ধরিয়ে দিয়ে কোরআন শরিফের একটি আয়াত বোর্ডে লিখতে বললেন। হোয়াইট বোর্ডের সামনে গিয়ে বললাম, ‘অনেক দিন চর্চা নেই। ভুল হয়ে যেতে পারে। কোরআনের আয়াত ভুল লেখা ঠিক নয়।’
এ নিয়ে তিনি আর জোরাজুরি করলেন না। এরপর বিষয়ভিত্তিক নানা প্রশ্ন করা হলো। সেখানে আমি নিজেকে যথেষ্ট সাবলীল প্রমাণ করতে সক্ষম হলাম। একপর্যায়ে একজন বোর্ড সদস্য চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ও কি যাবে, না আরও কিছু জিজ্ঞেস করবেন?’
চেয়ারম্যান সাহেব মুখ খানিকটা বিকৃত করে বললেন, ‘কী আর জিজ্ঞেস করব। ও তো আরবি-বাংলা কোনোটাই পারে না, যাক।’ মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে ঘরে ফেরার পথে সৈয়দ মুজতবা আলীর কথাগুলোর পুনরুক্তি করতে থাকলাম। পুরো ঘটনা জানার পর আমার স্ত্রী শুধু চরম লজ্জিত হলেন না; বরং নিজেকে ভীষণ অপরাধী মানতে শুরু করলেন।
তাঁর বিশ্বাস, আমার এই হেনস্তার কারণ বিয়ে এবং বিয়ের মূলে তিনি নিজে। ভাইভার সেই অভিজ্ঞতা আমাদের জীবন থেকে স্বস্তি কেড়ে নিয়েছিল বেশ কিছুদিনের জন্য। সেই ঘটনা আমাদের কাছে ভাইভার নামে মানসিক নিগ্রহেরই নামান্তর ছিল।
বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের দক্ষ কর্মী বাহিনী জোগান দিয়ে থাকে। উচ্চ বেকারত্বের এ দেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োগপ্রত্যাশীদের আশা-ভরসার একমাত্র প্রতিষ্ঠান এটি; বিশেষ করে ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োগের একমাত্র মাধ্যম পিএসসি। সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি তার সুষ্ঠু কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মানুষের আস্থা ধরে রেখেছে। বর্তমানে পিএসসি আস্থার জায়গাটাকে আরও সুসংহত করার জন্য সচেষ্ট হয়েছে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থার পাশাপাশি প্রত্যাশাও বেড়েছে।
আমরা জানি, পিএসসির নিয়োগ-প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে ভাইভা বা মৌখিক পরীক্ষা। কয়েক মাস আগে পত্রিকান্তরে জানা গিয়েছিল, নিয়োগ-প্রক্রিয়াকে অধিকতর নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ করার স্বার্থে পিএসসি মৌখিক পরীক্ষাসংক্রান্ত বেশ কিছু অনুশাসন জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পিএসসির এ সিদ্ধান্ত অবশ্যই ধন্যবাদযোগ্য। আশা করা যায়, এর ফলে ভাইভা নিয়ে প্রচলিত সব প্রশ্ন ও অভিযোগের অবসান ঘটবে।
গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক এখন থেকে বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষায় ভাইভা বোর্ডের সদস্যরা চাকরিপ্রার্থীদের বেশ কিছু বিষয়ে জানতে চাইবেন না বা কিছু বিষয়ে প্রশ্ন করবেন না। যেমন প্রার্থীর জেলা কোনটি, ধর্ম কী, কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিলেন ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রার্থীর ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগে বা প্রার্থী অপমানিত বোধ করতে পারেন, এমন কথাও ভাইভায় না বলার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। প্রার্থীকে সম্ভ্রমাত্মক ‘আপনি’ সম্বোধনের কথাও বলা হয়েছে। এখন থেকে ভাইভা বোর্ডের সদস্যদের সামনে প্রার্থীর রোল নম্বর ছাড়া আর কোনো তথ্য বা ডকুমেন্টস থাকবে না।
পিএসসির ভাইভা বোর্ডে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন এবং হেনস্তা নিয়ে অভিযোগ এন্তার। চাকরিভাগ্যের শিকে ছিঁড়তে ব্যর্থ অনেকে আমৃত্যু ভাইভা বোর্ডের সদস্যদের অভিসম্পাত করে যান। সব অভিযোগ যে সর্বাংশে সত্য তা যেমন বলা যাবে না, তেমনি অবান্তরও বলা যাবে না।রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশে বিশেষ বিশেষ অঞ্চল বা জেলার প্রার্থীদের ভাগ্য বদল হয় এমন কথা বেশ প্রচলিত।
বেসরকারি ব্যাংকের চাকরিতে থিতু হওয়া আমি এমন একজনকে জানি, যিনি তিনবার বিসিএসের ভাইভা দিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস, তাঁর জন্ম যদি বিশেষ একটি জেলায় না হতো, তাহলে তিনি সরকারি চাকরি পেতেন। ভাইভা বোর্ডের কোনো কোনো সদস্য নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি অনুকম্পাপ্রবণ হয়ে থাকেন বলেও জনধারণা প্রবল।
এই বাস্তবতায় ভাইভায় পরিবর্তনসংক্রান্ত পিএসসির সিদ্ধান্ত অনুসরণ বা বাস্তবায়ন করা জরুরি। এ প্রসঙ্গে পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমরা পিএসসিকে এমন একটি স্থানে নিয়ে যেতে চাই যাতে এ নিয়ে মানুষের প্রশ্ন না থাকে। এটি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে আমরা নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এরই অংশ হিসেবে ভাইভা বোর্ডের পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। বোর্ডে প্রার্থীর রোল নম্বর ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। যাতে তাঁর ব্যক্তিগত কোনো তথ্য কোনো পরীক্ষককে প্রভাবিত করতে না পারে।’
অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে পিএসসির কর্মকাণ্ড যে অনেক বেশি গতিশীল ও স্বচ্ছ, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ভাইভাসংক্রান্ত গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো দ্রুত বাস্তবায়িত হলে পিএসসির প্রতি চাকরিপ্রার্থীদের আস্থা আরও বৃদ্ধি পাবে এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার নিরপেক্ষতা প্রশ্নাতীত বলে প্রমাণিত হবে।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ