হোম > ছাপা সংস্করণ

ভাষা বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর অবদান

অধ্যাপক ড. মো. আবুল হোসেন

মূল ‘লাহোর প্রস্তাব’ (১৯৪০) পরিবর্তন করে জিন্নাহর উদ্যোগে ১৯৪৬ খ্রি. মুসলিম লীগের দিল্লি কনভেনশনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দুটি অঞ্চল নিয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে একটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয় চূড়ান্ত হলে গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও তমদ্দুন মজলিস বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার লক্ষ্যে গণসচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। ১৯৪৭ সালের শেষ দিকে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে গঠিত হয় প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।...১৯৪৮ সালের ১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। এই পরিষদের পক্ষ থেকে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনের দিন অর্থাৎ ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহ্বান করা হয়।...একপর্যায়ে পুলিশ শেখ মুজিবসহ কয়েকজন ছাত্রনেতাকে গ্রেপ্তার করে (চৌধুরী, ২০১৪: ৭০)।

গভর্নর জেনারেল জিন্নাহর ঢাকা সফর এবং ‘উর্দু, কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’–এমন ঘোষণার পর রাষ্ট্রভাষার দাবি রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে পরিণত হয়। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ এপ্রিল সেই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে।...শেখ মুজিবুর রহমানসহ ২৪ জনকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়...ব্যক্তিগত মুচলেকা প্রদানের মাধ্যমে অনেকেই নিজেদের ছাড়িয়ে নেন, কিন্তু শেখ মুজিব ছিলেন আদর্শ ও নীতিতে অটল। তাই ভাষা আন্দোলনের চরম মুহূর্তেও (২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২) তিনি জেলখানা থেকে ছাড়া পাননি (চৌধুরী, ২০১৪: ৭২)।

প্রসঙ্গত, উল্লেখ করা যেতে পারে যে প্রথম পর্বের ভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু জেলের বাইরে ছিলেন এবং তমদ্দুন মজলিস, মুসলিম ছাত্রলীগ, যুবলীগ ইত্যাদি সাহসী ভূমিকা রেখেছিল। বস্তুত সে কারণেই ১৯৪৯ সালে তিনি সেক্রেটারিয়েটের সামনে ভাষা আন্দোলনের প্রচারপত্র বিলি করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়ে যান (আকাশ, ২০১৫: ২০)। তবে ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব বা মূল পর্বে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা মূল্যায়নের সময় আমাদের মনে রাখতে হবে যে ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু জেলখানায় বন্দী ছিলেন। সেখান থেকেই তিনি ভাষা আন্দোলনের পক্ষে অনশনের মাধ্যমে তাঁর যতটুকু ভূমিকা সম্ভব, ততটুকু ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছেন। বঙ্গবন্ধু অনশন শুরু করেছিলেন ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ফরিদপুর জেলের ভেতরে। তাঁর সঙ্গী ছিলেন পরবর্তী সময়ে ন্যাপে যোগদানকারী নেতা আরেকজন সহরাজবন্দী মহিউদ্দিন আহমেদ। তাঁদের অনশনের মূল দুটি দাবি ছিল ‘রাজবন্দীদের মুক্তি’ এবং ‘রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার প্রতিষ্ঠা’। বঙ্গবন্ধু অনশন ভঙ্গ করেন প্রায় এক সপ্তাহ পরে, অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয় তার দুদিন পর, অর্থাৎ ২৭ ফেব্রুয়ারি (আকাশ, ২০১৫: ২০)।

ভাষা আন্দোলনের একটি পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম দায়িত্ব ছিল রাজবন্দীদের মুক্ত করা এবং বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিটি তাঁর দল আওয়ামী লীগে, বিশেষত সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। বিভিন্ন সূত্র থেকে (গোয়েন্দা রিপোর্ট এবং শেখ মুজিবকে লেখা সোহরাওয়ার্দীর চিঠি) আমরা এখন জানতে পেরেছি, ভাষা প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দীর অভিমত ছিল ‘বাংলা’ হবে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষা, অন্যতম রাষ্ট্রভাষা নয়। এই প্রশ্নে শেখ মুজিবের সঙ্গেও সোহরাওয়ার্দীর মতের মিল হয়নি। শেখ মুজিব এ ক্ষেত্রে তাঁর প্রিয় নেতার বিরোধিতা করতে কার্পণ্য করেননি (আকাশ, ২০১৫: ২১)।

গোপন সংস্থার একটি রিপোর্টে এই সময় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘Sk Mujibur Rahman disapproved the suggestions of Mr. Suhrawardy to give regional status of Bengali. Sk Mujibur Rahman received the suggestions of Mr. Suhrawardy through a letter. Other workers also did not agree with Surawardy. Their main demand was to make Bengali as one of the state languages of Pakistan’ (সরকার, ২০০৮: ১৮৪)। পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব সম্পর্কে এমন অসংখ্য গোপন নথিতে উল্লেখ রয়েছে।

১৯৫২ সালে খাজা নাজিমউদ্দীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি ঢাকায় এসে ঘোষণা করেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। সারা দেশে এর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। শেখ মুজিব তখন জেলে বন্দী, কৌশল করে জেল থেকে হাসপাতালে চলে আসেন। তাঁর এই হাসপাতালে আসার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করা। তিনি বিশ্বাস করতেন রাষ্ট্রভাষা না থাকলে জাতি হিসেবে বাঙালির অস্তিত্ব থাকবে না। জেল হাসপাতাল থেকেই ৩ ফেব্রুয়ারি শামসুল হক চৌধুরী, আবদুস সামাদ আজাদ ও ডা. গোলাম মাওলার মাধ্যমে তিনি একুশে ফেব্রুয়ারি হরতাল ডেকে গণপরিষদ ঘেরাও করার পরামর্শ দেন (আহমেদ, ১৯৯৯: ৩৯)।

১৯৫৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষার প্রশ্নে তাঁর প্রদত্ত ভাষণ ছিল উল্লেখযোগ্য। গণপরিষদে শেখ মুজিব তাঁকে বাংলা ভাষায় বক্তব্য রাখার সুযোগ প্রদানের জন্য স্পিকারকে অনুরোধ জানালে স্পিকার বললেন, ‘আপনি উর্দু এবং ইংরেজি জানেন না, এটা বললে বাংলার বিষয়টি ভেবে দেখব।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বাংলা আমার মাতৃভাষা। এ ভাষায় হাজার বছরের ঐতিহ্য রয়েছে, আমি বাংলাতেই ভাষণ দিব।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘না, যে ভাষার জন্য আমার ভাইয়েরা রক্ত দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন, সেই ভাষায় বক্তৃতা করে বিশ্বের দরবারে আমার মায়ের ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে চাই।’

মাতৃভাষায় বক্তব্য রাখার অধিকার দাবি করে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা এখানে বাংলায় কথা বলতে চাই। আমরা অন্য কোনো ভাষা জানি কি জানি না তাতে কিছুই যায়-আসে না। যদি মনে হয় আমরা বাংলাতে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি, তাহলে ইংরেজিতে কথা বলতে পারা সত্ত্বেও আমরা সব সময় বাংলাতেই কথা বলব। যদি বাংলায় কথা বলতে দেওয়া না হয় তাহলে আমরা পরিষদ থেকে বেরিয়ে যাব। কিন্তু পরিষদে বাংলায় কথা বলতে দিতে হবে। এটাই আমাদের দাবি।’ (আহমেদ, ২০২১: ৯৩)।

৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ পাকিস্তান ‘কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি’তে খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনাকালে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদাদানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘যেহেতু বাংলা এ দেশের ৫৬% লোকের ভাষা, তাই উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা প্রদান করতে হবে।’ (চৌধুরী, ২০১৪: ৭৯)।

ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন করার সংকল্পে উদ্বুদ্ধ হয়ে মহান একুশে উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে সপ্তাহব্যাপী এক কর্মসূচি গ্রহণ করে। এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বক্তৃতা দিতে গিয়ে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘যেদিন থেকে তাঁর দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে, সেদিন থেকেই অফিস-আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার শুরু হবে (জাহিদ, ২০২০: ৩৩)। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর সরকার ক্ষমতায় এসে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করে অফিস-আদালতের ভাষা বাংলা করে।

জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় বক্তৃতার মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে যায়। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সাফল্যের কারণেই বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান লাভ করে।

অধ্যাপক ড. মো. আবুল হোসেন: সভাপতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।

তথ্যসূত্র:

  • জাহিদ, জাহাঙ্গীর আল (২০২০), বাংলা ভাষার মর্যাদা পরিকল্পনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা, বাংলা একাডেমি পত্রিকা, ৬৪ বর্ষ: ১ম ও ২য় সংখ্যা, জানুয়ারি-জুন, পৃ-৩৫)।
  • আহমেদ, মহিউদ্দিন (১৯৯৯), বঙ্গবন্ধুর কারাসঙ্গী: ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি, ভাষা-আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু, পৃ. ৩৯।
  • সরকার, মোনায়েম (২০০৮), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি, (প্রথম খণ্ড), বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
  • আকাশ, এম এম (২০১৫), বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের নির্মাতা: ইতিহাসের ট্র্যাজেডি-ইতিহাসের শিক্ষা, বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী, আগস্ট, পৃ. ২০।
  • আহমেদ, নাসিরুদ্দিন (২০২১), প্রেক্ষিত ভাষা আন্দোলন: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান, পাথার, ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, জানুয়ারি-মার্চ।
  • চৌধুরী, রামেন্দ্র (২০১৪), হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী-মুজিব শ্রাবণ প্রকাশনী, একুশে বইমেলা পৃ-৮০।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ