একুশে ফেব্রুয়ারি দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে যাচ্ছে সূর্য। কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার পালা শেষ। চারদিকে থমথমে ভাব। এদিক-ওদিক ঘাসের ওপর পড়ে আছে টিয়ার গ্যাসের শেল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের সারি সারি ব্যারাকের কোনো একটির সামনে বসে আছেন মুর্তজা বশীর। সঙ্গে হাসান হাফিজুর রহমান। আরও অনেক ছেলে বসে আছে সেখানে। কেউ কাশছিল, আকাশের দিকে আধশোয়া হয়ে শুয়ে ছিল কেউ।
হঠাৎ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো কাঁটাতার ঘেরা সীমানা পেরিয়ে কালো পিচঢালা পথে সবুজ হেলমেট পরা সশস্ত্র পুলিশ সদস্যদের দেখা গেল। একজন পুলিশ অফিসার ছাত্রদের ডাকছেন। কয়েকজন ছাত্র সেদিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু ঠিক তখনই শুরু হলো গুলিবর্ষণ! ভয়ার্ত পাখির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়ল ছাত্ররা। চারদিকে আতঙ্কিত মানবসন্তান। আত্মরক্ষার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই। বশীর হঠাৎ দেখলেন, ব্যারাকগুলোর দক্ষিণ পাশে একটা জটলা। দৌড়ে সেখানে গেলেন তিনি। দেখলেন দীর্ঘদেহী এক শ্যামবর্ণ ছেলে। পরিষ্কারভাবে দাড়ি-গোঁফ কামানো। সারা মুখে ঘাম। আর তার প্যান্টের পেটের নিচ থেকে কল খুলে দেওয়া হলে যেভাবে পানি বের হয়, সেভাবে বেরিয়ে আসছে রক্ত।
সবার সঙ্গে ছেলেটাকে ধরলেন বশীর। কে যেন পিচকারির মতো বশীরের সাদা পায়জামায় ছড়িয়ে দিল রক্ত। ছেলেটার বুকের দিকটা ধরেছেন তিনি। মাথা বশীরের দিকে। ছেলেটি ধরা গলায় বলল, ‘আমার বাড়িতে খবর দেবেন…আমার নাম আবুল বরকত...পল্টন লাইন…।’ পরমুহূর্তে জবাই করা মুরগির মতো হাঁ করে জিহ্বা কাঁপিয়ে ছেলেটি ফিস ফিস করে বলল, ‘পানি... পানি…!’
কাঁদানে গ্যাস থেকে বাঁচার জন্য পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়েছিল রুমাল। মুখের ঘাম মোছার কারণে তা নোংরা। তারপরও মৃত্যুপথযাত্রী বরকতের জিহ্বায় নিংড়িয়ে দিলেন হাতের রুমাল।
ধরাধরি করে আবুল বরকতকে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। বশীর কোনো দিন ভোলেননি বরকতের সেই আর্তকণ্ঠস্বর, ‘পানি...পানি…।’
সূত্র: মুর্তজা বশীর, অম্লান বায়ান্নর স্মৃতি