হোম > ছাপা সংস্করণ

সহজ থেকে কঠিন পথে

মামুনুর রশীদ

স্বৈরাচার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা ক্ষণিকের জন্য একটু স্বস্তি পেয়েছিলাম বটে। কিন্তু স্বৈরাচার তত দিনে তার বহু বাহু বহু দিকে বিস্তৃত করে ঢুকে গেছে ভেতরে?

এই লেখাটা যখন লিখছি, তখন কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরছি। আজ একান্ন বছর পর সেই একাত্তরের ডিসেম্বরের কথা মনে পড়ছে। মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে দেশত্যাগের আগে দেশের নদীর পানি দিয়ে মুখটা ধুয়েছিলাম। আবার ফেরার সময় ইচ্ছে করল ‘ও আমার দেশের মাটি’ বলে মাটিতে মাথাটা ঠেকিয়ে নিজের কাছেই নিজের প্রত্যাবর্তনটা ঘোষণা করি। ফিরছিলাম দুদিকের ছিন্নভিন্ন ফসলের মাঠের মধ্য দিয়ে। আরিচায় ফেরির ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। বড় নৌকায় করে পার হতে হয়েছিল বিশাল নদী। একদিকে বিজয়ের উত্তেজনা আবার সেই সঙ্গে বুকের ভেতর এক গভীর জ্বালা।

আগেই শুনেছি মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সারসহ অনেকেই বেঁচে নেই। যুদ্ধে যাওয়ার আগে শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে দেখা করে গিয়েছিলাম। তিনি বিষণ্নচিত্তে বিদায়ও দিয়েছিলেন। আমি অনুরোধ করেছিলাম, তিনিও যেন ওপারে গিয়ে দ্রুত যুক্ত হন আমাদের সঙ্গে। তিনি তখন দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। তখনই তিনি পত্রিকাটি ছেড়ে যেতে চাননি। পরে যাবেন বলে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ঘাতকেরা তাঁকে ধরে নিয়ে যায় এবং পরে তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। কলকাতা থেকেই জেনেছিলাম তাঁর অনুজ জহির রায়হান ভাইকে খুঁজতে খুঁজতে অনেক বিপজ্জনক জায়গায় গিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনিও আর ফেরেননি। এক মারাত্মক আঁধার তাঁকে গ্রাস করেছে।

একদিকে নতুন দেশের আনন্দ, অন্যদিকে অনেক প্রিয়জন হারানোর বেদনার একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়াও অনুভব করলাম। দেশে ফিরে দিন কয়েকের মধ্যে আনন্দের চেয়ে দুঃখবোধ বাড়তে থাকল দেশের ভেতর নানা ধরনের বিভক্তি দেখে। ‘সিক্সটিন ডিভিশন’ নামে একধরনের বাহিনী গাড়ি নিয়ে, অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি, যাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই ছিল না। মুক্তিযুদ্ধকালে একটা ভ্রান্ত ধারণা নিয়েই ছিলাম আমরা। ভেবেছিলাম তখনকার পুরো জনগোষ্ঠীই বোধ হয় যুদ্ধ করছে। আসলে তা যে সত্য নয়, এটা টের পেতে অনেক সময় লেগে গেছে আমাদের।

১৯৭৫ সালের গোড়া থেকে অথবা তার আগে থেকেই একটা ষড়যন্ত্র চলছিল, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটল ১৫ আগস্টে। তারপর দেশটাকে যে আবার পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হলো, তার কত-কী যে আমরা দেখেছি! অবশ্য সেই থেকে জাতিটা বহুভাবে বিভক্ত হয়ে গেল, ধর্মও রাজনীতির একটা বড় শক্তি হয়ে দেখা দিল। যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্যের কথা বলে রাজনীতি করেন, তাঁরা ষাটের দশকে ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। মুক্তিযুদ্ধেও তাঁরা যথেষ্ট অবদান রাখেন। বাহাত্তর-তিয়াত্তর সালে বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বাম ছাত্রসংগঠনই নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু পঁচাত্তরের পরে তাঁরা ক্রমাগত নিষ্ক্রিয় ও দিশেহারা হয়ে পড়েন। অন্যদিকে বাম শক্তির কেউ কেউ যখন বিপ্লবের পথ ছেড়ে পুঁজির পথ বেছে নেয়, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ছত্রচ্ছায়ায় পুঁজি যেমন প্রবেশ করে, তেমনি তার সঙ্গে এসে অতন্দ্রপ্রহরীর মতো দাঁড়ায় ধর্ম।

শামসুর রাহমান স্বাধীনতা নিয়ে একটি দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন ওই সময়। মানুষের ভালোবাসার সব চিত্রকল্প নিয়ে কবিতাটি পাঠককে বড়ই আলোড়িত করে। কিন্তু স্বাধীনতা বলে কি সত্যিই কিছু আছে? মানুষ তার জন্মের পর থেকেই নানাভাবে পরাধীন। স্বাধীনতা অর্জনের পথ কঠিন। কিন্তু কঠিনতর হয় যখন তাকে রক্ষা করতে হয়। দেশের ভেতরে শত্রুরা প্রথমে সক্রিয় হয়। তারপর তার সঙ্গে হাত মেলায় বিদেশি শক্তি। ব্যবসা-বাণিজ্যের ছুতোয়, সাহায্যের আশ্বাসের বিনিময়ে আমরা বিকিয়ে দিই স্বাধীনতা।

তাহলে প্রশ্ন জাগে, পৃথিবীর সব দেশই কি স্বাধীনতার রক্ষীরা লড়াইয়ের কাজে যুক্ত রয়েছেন? অবশ্যই। শুধু রাষ্ট্র নয়, সেখানে ব্যক্তিবিশেষও জড়িত। একটা বিষয় তাঁরা অনুধাবন করতে পেরেছেন যে শিশু মায়ের কোল ছেড়ে যেখানে যায়, সেটা হলো স্কুল। ওই স্কুলে সঠিক শিক্ষা পেলে এবং নিজের মেরুদণ্ড সোজা হলে সে সব অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামবে। এ লড়াই চলবে আজীবন।

এই ব্যক্তিস্বাধীনতার পথ ধরেই আসে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। একান্ন বছর ধরে এই যে অধিকারচর্চার বিষয়টিও অনুচ্চ থেকে গেছে, তার কারণও শিক্ষাক্ষেত্রে দিকনির্দেশনার অভাব। একটা স্বাধীন জাতির শিক্ষা-সংস্কৃতিটা কেমন হবে, সেটা সেভাবে অনেকের কাছেই স্পষ্ট হয়নি। সরকারের প্রতি অনুগত একটি শিক্ষাব্যবস্থা কোনোভাবে মানুষকে সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যেতে পারে কি?

স্বৈরাচারি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা ক্ষণিকের জন্য একটু স্বস্তি পেয়েছিলাম বটে। কিন্তু স্বৈরাচার তত দিনে তার বহু বাহু বহু দিকে বিস্তৃত করে ঢুকে গেছে ভেতরে। তার প্রমাণ রাষ্ট্র, সরকার, সমাজ, পরিবার—সর্বত্র সেই অপসংস্কৃতিকেই দেখতে পাই। অতীতে মানুষের জীবনযাপনের জন্য সরল একটা সংস্কৃতি ছিল। পরে জীবনের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতিও জটিল হয়েছে। সেই জটিল জীবন ও সংস্কৃতিকে বুঝতে, চিনতে এবং মানবিক করতে যে শিক্ষার প্রয়োজন ছিল, তার কোনো ব্যবস্থাই করা সম্ভব হয়নি।

রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান ভাবনা—ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা। এই সার্বক্ষণিক ভাবনায় নিমগ্ন থাকা রাজনীতিকেরা পেশাগত, দক্ষ, জ্ঞানী, অভিজ্ঞ লোকদের দিয়ে নতুন কোনো পথের সন্ধান করতে পারেননি। বহু ধারায় বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা যে শুধু জাতিকে বিভক্ত করে তা-ই নয়, জাতির সংস্কৃতিটাকেও ভেঙে চুরমার করে দেয়। যে সহজ পথে সহজ পাঠ দেওয়া যেত, তা দিনে দিনে কঠিন হয়ে পড়েছে। সেই পথ ধরেই সমাজে ঢুকে পড়েছে অসত্য, দুর্নীতি এবং বড় ধরনের বিশ্বাস ভঙ্গের ধারা।

একান্ন বছরে যে আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট দেখা দিয়েছে, তা থেকে জাতিকে ফিরিয়ে আনতে হলে অবিলম্বে শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। সংক্ষিপ্ত পথকে পরিহার করতে না পারলে জাতীয় দৈন্য একটা দানবের মতো আমাদের গ্রাস করবে। এবারের বিজয় দিবস উদ্‌যাপনের প্রাক্কালে গৌরবের 
সঙ্গে অগৌরবের বেদনাও আছে।

তবে আশা করি, বাঙালি সাময়িকভাবে বিভ্রান্তির কবলে পড়লেও জয়ের ধারায় অবশ্যই ফিরবে।

লেখক: মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ