হোম > ছাপা সংস্করণ

ত্বকী হত্যার বিচার কেন চাই

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

ত্বকী হত্যার বিচার চেয়ে আমরা সমবেত হই বছরের পর বছর ধরে এবং প্রতিবছরই আমাদের অনুভূতি হয় এ রকমের যে আমরা অপরাধী। এই কিশোরকে আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। আমরা যে কেবল ত্বকী হত্যার বিচার চাই, তা নয়। আমরা এটাও চাই যে ত্বকীরা যেন সমাজে বাঁচতে পারে। তাদের যে মেধা, তাদের যে সম্ভাবনা, তাদের জ্ঞানানুশীলনের যে আগ্রহ, সেগুলো যেন তারা বিকশিত করতে পারে।

ত্বকীকে আমি প্রতীক হিসেবে দেখতে পাই। বাংলাদেশের কিশোরদের একজন প্রতীক। যে কিশোর গান গায়, পড়াশোনা করে, সুধীজন পাঠাগারে নিয়মিত যায়, আন্দোলনে থাকে, মিছিলে যায় এবং স্বপ্ন দেখে, এই অন্যায়ে ভরা সমাজ, জগৎটাকে সে বদলাবে। ত্বকীকে আমি সেই কৈশোরের, সেই অঙ্গীকারের প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে পাই।

আবার তার ওপরে যে আক্রমণ হয়েছে, সে যে বাঁচতে পারল না, এত অল্প বয়সে কৈশোরেই সে ঝরে গেল, সেটাও একটা প্রতীক। যেন আলোর সঙ্গে অন্ধকারের যে দ্বন্দ্ব বাংলাদেশে চলছে, তারই প্রতীক। তো আমরা এই দুটো সত্যের মধ্যে আছি। এই যে কিশোরেরা আছে, আলো আছে, ত্বকী আছে, আবার অন্ধকার আছে; যে অন্ধকার ত্বকীকে গ্রাস করে ফেলেছে। প্রশ্ন হলো, এই দুইয়ের মধ্যে কোনটা জয়ী হবে। আমরা ত্বকীর মৃত্যুর কথা স্মরণ করি তখন, বিশেষভাবে এই প্রশ্নটাই সামনে আসে যে কে জয়ী হবে বাংলাদেশে। আলো, নাকি অন্ধকার?

আমরা তো দীর্ঘকাল ধরে সংগ্রাম করে এসেছি। এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে এই দ্বন্দ্বটা রয়ে গেছে। আমরা আমাদের চতুর্দিকে এখন যেটা দেখতে পাচ্ছি, সেটা হলো একটা ভীতি। মানুষ একটা ভয়ের মধ্যে আছে। নানান রকমের ভয়। তার নিরাপত্তা নেই, মেয়েদের নিরাপত্তা নেই, জীবিকার নিরাপত্তা নেই, চলাফেরার নিরাপত্তা নেই। রাস্তায় বেরোলে গাড়িচাপা পড়ে মারা যায়, হত্যাকাণ্ড হয়, জিনিসপত্রের দাম অসম্ভব বাড়ছে। এ ছাড়া কোন কথা বলে বিপদে পড়বে—এই ভয়ও আছে। অন্যদিকে আবার এসব ভয়ের কারণে হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। ভয়ের আরেকটা কারণ হচ্ছে বিচার নেই। বিচারহীনতার একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে।একদিকে ভীতির সংস্কৃতি, আরেকদিকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এ কারণে একটা হতাশা দেখা দিচ্ছে যে আমরা বোধ হয় পরাজিত হয়ে গেছি।আরেকটা কথা আমার খুব মনে পড়ে। নারায়ণগঞ্জ শহর ছিল সংস্কৃতির প্রতীক, খেলাধুলার প্রতীক। আমরা কৈশোরে, যৌবনে ওই শহরে যাতায়াত করতাম ঢাকা থেকে।

আমরা আনন্দিত হতাম ওই সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে, নদীর ধারে গিয়ে। নারায়ণগঞ্জ বিখ্যাত ছিল খেলাধুলার জন্য। সেই নারায়ণগঞ্জের যে দুর্দশা আজকে হয়েছে, সেই দুর্দশা আমাদের বাংলাদেশেরই প্রতীক।

আজ বাংলাদেশে কিশোরেরা যে অবস্থায় আছে, তারও একটা প্রতীক এখানে আমরা দেখতে পাই। এখানে কিশোর বেঁচে থাকতে পারে কোনোমতে। কিন্তু সেই বেঁচে থাকা কিশোরের মতো বেঁচে থাকা নয়। কিশোরদের জীবনে আনন্দ নেই, বৈচিত্র্য নেই, খেলাধুলা নেই। কিশোরেরা এখন অপরাধীতে পরিণত হচ্ছে, মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে এবং কৈশোরেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর কৈশোর নষ্ট হয়ে যাওয়া মানেই হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাওয়া। এই জায়গাটাও আমাদের দেখতে হবে। নারায়ণগঞ্জ শহর যেভাবে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল, কৈশোর চলে গেল। এটা হচ্ছে পুরো বাংলাদেশের চিত্র। কিন্তু এর বিরুদ্ধেই আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে। আমাদের ভরসার জায়গা কিন্তু কিশোরেরাই।

আমি আরেকটি বিষয় দেখতে পাই। সেটা হচ্ছে, ত্বকী একটা পাঠাগারে যাচ্ছিল। সেই পাঠাগার থেকে সে বই আনবে। আনার পথে দুর্বৃত্তরা তাকে হত্যা করল। এটাও একটা প্রতীকের মতো মনে হয়, আমাদের দেশে সংস্কৃতিচর্চা কেমন বিপদের মধ্যে আছে, কেমন একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে, কেমনভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। এখন যদি আমরা হতাশ না হতে চাই, যদি আমরা পরাজিত না হতে চাই, যদি আমরা আমাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে চাই, তাহলে আমাদের কর্তব্য হবে দেশে একটা সাংস্কৃতিক জাগরণ তৈরি করা। লক্ষ্যটা হবে ওই যে মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা, যে চেতনা আমাদের আদি সংবিধানে লেখা ছিল রাষ্ট্রীয় চারটি মূলনীতির মধ্যে, তার বাস্তবায়ন করতে হবে তো বটেই।

আরও বেশি করে যেটা করতে হবে সেটা হলো, একটা সামাজিক বিপ্লব ঘটানো। সেই বিপ্লব বাংলাদেশে ঘটেনি। আমরা ব্রিটিশ আমলে যে ব্যবস্থার মধ্যে ছিলাম, পাকিস্তান আমলে তার চেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে ছিলাম, আজ বাংলাদেশে কি আমরা খুব ভালো আছি? ওই যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিয়ে গিয়েছিল ইংরেজরা; জমিদার ও প্রজার সেই সম্পর্কটাই পুনঃ উৎপাদিত হচ্ছে নানা ক্ষেত্রে। কেউ বিত্তবান, কেউ মনিব; অন্যরা বিত্তহীন, সুযোগবঞ্চিত, প্রজার মতো আছে। সেই জায়গাতে আমরা পরিবর্তন আনতে পারিনি। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের তাড়িয়েছি, কিন্তু ওই যে সম্পর্ক, মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক, যে মানবিক সম্পর্ক, সাম্যের সম্পর্ক, অধিকার-সুযোগ ও সমতার যে সম্পর্ক, সেটা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা যখন আমরা বলি, তখন চেতনা বলতে আমরা এটা বুঝি যে এই চেতনা হচ্ছে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের চেতনা, সমাজ পরিবর্তনের চেতনা। পাকিস্তান বড় রাষ্ট্র ছিল, ব্রিটিশদের আরও বড় রাজত্ব ছিল। সেগুলো টুকরো টুকরো করে ছোট রাষ্ট্র হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের ভেতরের যে চেহারা, আইনকানুন, সেগুলো তো বদল হয়নি। মানুষের তো নিরাপত্তা আসেনি।

এ কাজটা রাজনৈতিক। রাষ্ট্রের চরিত্র বদলাতে হবে, রাষ্ট্রকে মানবিক করতে হবে, মানুষের জীবনে নিরাপত্তা আনতে হবে। কিন্তু এর জন্য সাংস্কৃতিক যে প্রস্তুতি, সেই প্রস্তুতিটা খুব জরুরি। ত্বকী সেই সাংস্কৃতিক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল। ত্বকীর বাবা সেই সাংস্কৃতিক কাজের সঙ্গে জড়িত আছেন। এখন সংস্কৃতির চর্চা নেই। অন্ধকার হয়ে গেছে, মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মানুষ হতাশ হয়ে পড়ছে। মানুষ যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। সেই জায়গা থেকে মানুষের মুক্তির জন্য, সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের জন্য একটা কিশোর আন্দোলনও প্রয়োজন।

সুধীজন পাঠাগারের প্রসঙ্গটি আমার মনে আসে। এ রকম পাঠাগার বাংলাদেশে বিরল বটে। কিন্তু তা যে একেবারেই ছিল না, তা নয়। পাঠাগার অনেক আছে। তবে পাঠাগারগুলো এখন প্রাণবন্ত নয়। সেখানে মানুষ বই পড়তে যায় না, বই পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে সবাই। এই পাঠাগারগুলোকে হয়তো আমরা জীবন্ত করতে পারব না।

কিন্তু আমরা যা করতে পারি সেটা হলো, এই পাঠাগারগুলোকে আমরা সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারব। যেখানে কেবল বই পড়া হবে না, কেবল বইয়ের আদান-প্রদান হবে না, আলোচনা হবে, বক্তৃতা হবে। তার সামনে যদি জায়গা থাকে সেখানে নাটক হবে, যদি হল থাকে, সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। কুচকাওয়াজ হবে, খেলাধুলা হবে। কেবল কিশোরেরা সেখানে যাবে না, তাদের অভিভাবকেরা যাবেন, সব মানুষ যাবেন।

ত্বকী ওই কাজটার সঙ্গেই যুক্ত ছিল। সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সেই সংস্কৃতিচর্চাটাকে আমাদের আবার পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। কারা করবেন? তাঁরাই করবেন যাঁরা বিবেকবান ও বুদ্ধিমান। বিবেক ও বুদ্ধিকে এখানে একত্র করতে হবে। বিবেক বলবে, এই সমাজ অন্যায়, এই ত্বকীদের চলে যাওয়াটা অন্যায়, ত্বকীকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারাটা আমাদের অপরাধ। সেটা একটা বিবেকের প্রশ্ন এবং বুদ্ধি বলবে, বুদ্ধিমান মানুষ বলবে যে এই সমাজকে বদলাতে হবে। এই সমাজ মানবিক নয়, এখানকার সম্পর্কগুলো অমানবিক, এখানে শোষণ চলে, এখানকার সম্পদ পাচার হয়ে যায়। সে সম্পদ ব্রিটিশদের সময়ে লন্ডনে চলে গেছে, পাকিস্তান আমলে করাচিতে গেছে, আজ পৃথিবীর নানা শহরে, নানান রাজধানীতে সেই সম্পদ চলে যাচ্ছে। আমাদের মেধা, সে-ও পাচার হয়ে যাচ্ছে। সম্পদ পাচার হচ্ছে, মেধা পাচার হচ্ছে। মেহনতি মানুষের শ্রমের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র ও সমাজ টিকে আছে কোনোভাবে। কাজেই এই ব্যবস্থাটা বদল করার জন্য যে রাজনীতি প্রয়োজন, সেই রাজনীতির জন্য সংস্কৃতির চর্চা দরকার। আমরা যারা বিবেকবান, বুদ্ধিমান—আমাদের বুদ্ধি বলছে যে এটা বদলানো দরকার, হৃদয় বলছে, বিবেক বলছে যে এটা সহ্য করা যায় না।

কাজেই ত্বকী হত্যার বিচার আমরা চাই। অবশ্যই সে বিচার হবে। কিন্তু এই বিচার শুধু নয়, ত্বকীরা যাতে নিরাপদে এখানে থাকতে পারে; ত্বকীরা যাতে তাদের মেধা, প্রতিভা, সম্ভাবনা ও আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে পারে, সেটাও আমরা চাই। এই সমাজ যাতে মানবিক সমাজ হয়, সেটা দেখাও আমাদের কর্তব্য। সংস্কৃতিচর্চার আরেকটি উপাদান হচ্ছে জ্ঞানানুশীলন। যেটা ত্বকী করত। সে পাঠাগারের লোক ছিল। সেই জ্ঞানানুশীলনও বাংলাদেশে অনেক নিচের দিকে চলে গেছে। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার, পরিমাণগতভাবে আমাদের শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে, কিন্তু গুণগতভাবে শিক্ষাকে আমরা উন্নত করতে পারলাম না। ত্বকীর বিচারের জন্য আন্দোলন তাই সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনও বটে। এ কথাটাও আমাদের মনে রাখতে হবে, এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ