রান্নাঘরের চতুর্পাশ খোলা। বিকেলে ওই রান্নাঘরে বসেই পিঠা ভাজছিলেন পুতুল রানী (১৮)। পরনে তাঁর লাল, হলুদ, সাদা রঙের ফুল তোলা প্রিন্টের শাড়ি, দুই হাতে শাঁখা। হাতা (চামচ) দিয়ে চুলার ওপরে কড়াইয়ে পিঠা ওলটাচ্ছেন। কাছে যেতেই তিনি মুচকি হেসে মুখে ঘোমটা টেনে টুল দিয়ে বসতে বলেন। হামলার কথা তুলতেই বললেন, ‘হ, সেদিন কি যে একটা রাত গেচে। কবার পাবো না। ভয়ে জীবনটা শ্যাষ হবার ধচ্চিলো। কোনোমোতে জীবন বাঁচি গ্যাচে। ওংক্যা ঘটনা জানি মান্সের উপোর না হয়। একন খুব ভাল নাগোচে। সবাই হামার খোঁজ ন্যাওচে।’
পুতুল রানী পীরগঞ্জের বড় করিমপুর কসবা হিন্দুপল্লি মাঝিপাড়ার সুদাসন চন্দ্রের স্ত্রী। বছরখানেক আগে পুতুলের বিয়ে হয়েছে। ১৭ অক্টোবর রাতে ওই পাড়ায় সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয় পুতুলের পরিবার। তাঁর মতো আরও ২৪টি পরিবারের বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। আতঙ্কিত লোকজন প্রাণভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে আশপাশের জঙ্গল, ধানের খেতে আশ্রয় নেন। এ সময় উগ্রবাদীদের দেওয়া আগুনে ৩১টি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ২টি গরুও পুড়ে ভস্ম হয়। ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় প্রায় অর্ধশত বাড়িতে। সাম্প্রদায়িক ওই হামলায় ঝড় বয়ে গেছে পুতুলদের জীবনে। সেই হিন্দুপল্লির বাসিন্দাদের মাঝে এখন ধীরে ধীরে আতঙ্ক কাটছে। ফিরছে স্বস্তি। সরকারের পাশাপাশি তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থা, মানবিক ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। খাদ্য, বস্ত্র ও অর্থ সহযোগিতা পেয়েছেন তাঁরা।
এরই মধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া ১০০ বান্ডিল টিন দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরগুলো মেরামত প্রায় শেষের দিকে। প্রতিটি বাড়িতেই এখন লোকজন বসবাস করছেন। তিন দিন আগেই রেড ক্রিসেন্টের দেওয়া চারটি তাঁবু গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর তিন দিন (শুক্রবার থেকে) ধরে নিজ বাড়িতে চুলায় রান্না করে খাবার খাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
গতকাল কথা হয় মাঝিপাড়ার ননী গোপালের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘হামলায় হামার যে ক্ষতি হচিলো। সরকার আর অন্যান্যরা হামাক নগদ ট্যাকা, খাবার, কাপড়চোপড় দিয়া সাহায্য করছে। হামরা একন ভালো আচি।’ তাঁর মতোই অনুভূতি ব্যক্ত করলেন সুবর্ণ চন্দ্র, শহিবা রানী, অর্জুন চন্দ্র, রমেন, নিখিল চন্দ্র। সুবর্ণ চন্দ্র বলেন, ‘হামার মনোত যে ভয় হচিলো। তাতে মনে হচিল, হামরা আর এটি থাকপ্যার পাবালই (পারব না)! একন আর সমেস্যা নাই।’
পীরগঞ্জ থানার ওসি সরেস চন্দ্র বলেন, হামলার শিকার পরিবারগুলোতে ভয়, শঙ্কা নেই। ধীরে ধীরে আতঙ্ক কাটছে। তাঁরা স্বাভাবিক হচ্ছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিরোদা রানী রায় বলেন, ‘হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িঘর নতুন করে নির্মাণ করছি। আবার কোনোটা মেরামত করছি। ক্ষতিগ্রস্তরা যেভাবে চাইছেন, সেভাবেই ঘর করে দেওয়া হচ্ছে।’