হোম > ছাপা সংস্করণ

নাগরিকের অধিকার চেতনা

মামুনুর রশীদ

রাজনৈতিক দলগুলো শুধু ক্ষমতা আঁকড়ে ধরবে, নিজেরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করবে এবং একটা পর্যায়ে তাদের ক্ষমতা থাকবে না। কিন্তু অন্য দলটি এসে তেমন কোনো পরিবর্তনের পথ দেখাবে না। অতীতে যারা ক্ষমতায় ছিল তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই শুধু সংগ্রাম করে।

রাষ্ট্রের উত্থানের পেছনে একসময় পেশিশক্তির প্রভাব ছিল। কখনো সেনাপতিরা রাষ্ট্র অধিকার করত। কিন্তু কালক্রমে দার্শনিকেরা রাষ্ট্রে রাজার বিপরীতে প্রজার ভূমিকাকে মুখ্য করার চেষ্টা করেন। ইতিহাসের একটা পর্যায়ে রাষ্ট্রে কল্যাণ চিন্তা আসে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা করা হয়। কিন্তু এর মধ্যে পুঁজিবাদ একটা শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। সেনাবাহিনীর পেশিশক্তি আর পুঁজিবাদের অর্থ—এই দুটো মিলে একটা রাষ্ট্রব্যবস্থার উত্থান ঘটে। কালক্রমে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হতে আমরা দেখেছি। কিন্তু পুঁজির শক্তির কাছে তা টেকেনি।

সব রাষ্ট্রেরই একটা উদ্দেশ্য থাকে—রাষ্ট্রের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। নাগরিকের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, পথঘাট নির্মাণ—এসবই সুরাষ্ট্রের নিয়ামক। যদিও এই সব অর্থের উৎস হচ্ছে নাগরিকদের দেওয়া রাজস্ব। রাষ্ট্রের যারা শাসক, তাদের হাতেই থাকে রাজস্ব। তবে কালক্রমে একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রেও অর্থের একটা জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা হয়। রাষ্ট্র এই অর্থের দায়িত্ব নিয়ে থাকে এবং সেই অর্থের কোনো গোলমাল হলে তা সুবিচার করারও প্রতিশ্রুতি দেয়। একমাত্র সামরিক শাসনের সময় যখন সংবিধান মুলতবি থাকে, তখনই কোনো জবাবদিহির প্রশ্ন আর ওঠে না।

আমাদের রাষ্ট্র স্বাধীনতা অর্জন করেছে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। সুদীর্ঘ সময় ধরে তা সামরিক শাসনের পদতলে থাকার ফলে কোনো জবাবদিহি ছিল না। কিন্তু এই রাষ্ট্রে নাগরিকদের কষ্ট কখনো মোচন হয়নি। বিভিন্ন সময়ে রাস্তাঘাট নির্মাণ, সম্প্রসারণ ও মেরামতের কাজে এত দীর্ঘ সময় লেগে যায় যে নাগরিকদের কষ্টের সীমা থাকে না। সাধারণত এই কাজগুলো আগে হতো বর্ষাকালে। এখন শীতকালে শুরু হলেও তা শেষ হতে বর্ষা পার হয়ে আরেকটি শীত চলে আসে। বড় ধরনের কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করতে গেলে মানুষের কষ্ট হয়, কিন্তু যখন অবকাঠামোটি নির্মাণ শেষ হয়, তখন সেই কষ্ট মানুষ ভুলে যায়।

তবে এখানে যেটা শুরু হয় সেটা হচ্ছে, এক অনন্তকালের কষ্ট! ঢাকা থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত উড়ালপথ করতে গিয়ে মাটি কাটা ও অন্যান্য কাজ যে শুরু হয়েছে তার যেন শেষ নেই। স্বল্পসংখ্যক শ্রমিক নিয়ে ঠিকাদারেরা কাজ করতে থাকেন শম্বুকগতিতে। এর মধ্যে নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়তে থাকে, ঠিকাদারদের কাজ তখন আরও শম্বুকগতিতে চলতে থাকে এবং নির্মাণের সময় অনেক জীবনকে আত্মাহুতি দিতে হয়। কখন কোন রাস্তা বন্ধ হবে এবং কখন কোন রাস্তা খুলবে, তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। সব ধরনের নির্মাণ ব্যয় বাড়তে থাকে, রাষ্ট্র সেই নির্মাণ ব্যয়ের ব্যবস্থাও করে দেয়। কিন্তু দ্রুত কাজটি সম্পন্ন হলে মানুষের যে কষ্ট লাঘব হতো, তা নির্মাণকাজে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তা ও ঠিকাদারেরা বুঝতে চান না।

শুধু তা-ই নয়, রাস্তাঘাট নির্মাণ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে তা প্রায়ই ভাঙাচোরা চেহারা থাকে। এত দ্রুত নির্মাণকাজটি যে মেরামতের প্রয়োজন পড়বে, তা কর্মকর্তারা বুঝতে পেরেও কোনো ব্যবস্থা নেন না। অতিরিক্ত কষ্টসহিষ্ণু এই জাতির ওপর সবকিছু চাপিয়ে দিয়ে তাঁরা বিপুল অর্থের মালিক হন। আজকাল বড় বড় নির্মাণকাজ আর দেশি ঠিকাদারেরা করেন না। দেশের বাইরের ঠিকাদারেরা কাজটি সম্পন্ন করে চলে যান। তারপর এসব দেখভালের দায়দায়িত্ব পড়ে দেশের প্রকৌশলীদের ওপর। তাঁরা যে মেরামতের কাজটি করেন, তা খুব নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে। ফলে মেরামতের খরচ বাড়তেই থাকে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের দুর্ভোগও বাড়তে থাকে।

আমাদের বড় বড় জলাশয় ও বিশাল নদী আছে। সেই নদীর ভাঙন রোধ করতে গিয়ে বাঁধ দিতে হয়। এই বাঁধ একবার দিলে হয় না। বহুবার বাঁধ দিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ অর্থের যে শুধু অপচয় হয় তা-ই নয়, অপরিকল্পিত এই বাঁধ বারবার বন্যাও ডেকে আনে। মানুষ গৃহহীন হয়ে, সর্বস্বান্ত হয়ে একসময় শহরে এসে আশ্রয় নেয়।

ছোটবেলায় শুনেছি হোয়াংহো নদী চীনের দুঃখ ছিল। কিন্তু বিপ্লবোত্তর চীনের সরকার সেই দুঃখকে জয় করতে সক্ষম হয়েছে। কীভাবে সক্ষম হয়েছে তার জন্য সারা বিশ্বের প্রকৌশলীদের সঙ্গে আমাদের প্রকৌশলীরাও চীন দেশ ভ্রমণ করেছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা নেদারল্যান্ডস থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কিন্তু সেই প্রশিক্ষণ কোনো কাজে লেগেছে কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

এ তো গেল পথঘাটের কথা। শিক্ষার ক্ষেত্রে কী হচ্ছে? একটা পাঁচ বছরের শিশুকে স্কুলে ভর্তি হতে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হয়, না হলে উন্নত মস্তিষ্কের আবিষ্কার লটারিতে ভাগ্য নির্ধারণের জন্য অংশগ্রহণ করতে হয়। লটারিতে যাদের ভাগ্য খুলল না, তাদের কী হবে? তাদের একটা খারাপ স্কুলে অথবা মাদ্রাসায় ভর্তি হতে হয়। মাদ্রাসায় ভর্তি হতে কোনো পরীক্ষা লাগে না। দেশের মুষ্টিমেয় ভালো স্কুল আছে আর বাকি সবই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা বিদ্যালয়। যে শিশুটি ভালো স্কুলে ভর্তি হতে পারল না, সে কালক্রমে ‘খারাপ’ স্কুলের ছাত্র হয়ে ‘খারাপ’ ছাত্রই রয়ে গেল! ভালো ছাত্র হতে গেলে ভালো টাকারও প্রয়োজন, কোচিং লাগে। ভালো স্কুলের বেতনও বেশি, তাই এখানে মেধা বিকাশের কোনো অবকাশ নেই। আর যাদের অনেক বেশি টাকা আছে, তারা ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য বাংলার ধারও ধারে না। প্রথমে ইংরেজি স্কুলে এবং পরে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। অভিভাবকদের আহাজারিতে কিচ্ছু আসে-যায় না।

স্বাস্থ্যের অবস্থা যে কী গুরুতর, তা বিদেশি দূতাবাসে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো রোগীদের দিকে তাকালে বোঝা যায়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে দালাল এবং তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের দাপটে চিকিৎসকেরাও তটস্থ থাকেন। একেবারে অপ্রতুল চিকিৎসাব্যবস্থায় রোগীর হাহাকার করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। আর এর মধ্যে আছে পরিবহনব্যবস্থায় মালিক ও শ্রমিকদের দাপট। তাহলে বিষয়টা দাঁড়ায়—পথচারীর দুঃখ লাঘব হয় না এবং পরিবহনে যাতায়াত এখনো বিঘ্নমুক্ত নয়।

শিক্ষায় প্রবল বিশৃঙ্খলা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা অপ্রতুল, তার সঙ্গে যুক্ত হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি। এই সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত আছে রাষ্ট্র এবং তার ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের যে ব্যবস্থা নেই তা নয়, কিন্তু ব্যবস্থাটি একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আবার একেবারেই যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে তা নয়, এসব কিছুকে কেনা যায় অর্থ দিয়ে। এই অর্থ দুর্নীতির অর্থ। আবার রাষ্ট্রের অর্থব্যবস্থাটি এতই নাজুক যে এই দুর্নীতির অর্থ সহজেই বিদেশে পাচার করা যায়। দেশপ্রেমবিহীন পুঁজিপতিরা অনায়াসে এই সুযোগটা নিতে কার্পণ্য করে না। আর সরকারও তাদের বাজেটে নানাভাবে ওই পুঁজি জায়েজ করার জন্য ব্যবস্থা করে দেয়। তাহলে সবটা মিলিয়ে কী দাঁড়ায়?

সবচেয়ে অসহায় দেশের সৎ নাগরিকেরা। যে নাগরিকের উৎকোচ দেওয়ার সামর্থ্য নেই, বেশি পয়সা খরচ করে সন্তানদের শিক্ষা গ্রহণের উপায় নেই, মুমূর্ষু রোগীরও উন্নত চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই, এসব নাগরিক শুধু মাথা ঠুকে মরে এবং তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। আবার বিদেশে যারা অর্থ পাচার করে এবং সব রকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, তাদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। পুঁজিবাদের একটা বড় উপহার হচ্ছে বিচারব্যবস্থা। এই বিচারব্যবস্থা সুনাগরিকের জন্য আশীর্বাদ হওয়ার কথা। কিন্তু বিচারহীনতার কালক্ষেপণে প্রতিনিয়তই বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে।

আমাদের রাষ্ট্রটি তাহলে কোন জায়গায় অবস্থান করছে? কল্যাণ রাষ্ট্র থেকে, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র থেকে বহুদূরে আমরা দিন যাপন করি। অথচ সমাজতন্ত্রের কথা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মৌল আদর্শের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। নাগরিকেরা এই ব্যবস্থাকে যেন মেনেই নিয়েছে এবং তারা ভেবে নিয়েছে এর কোনো প্রতিকার নেই, এই পরিস্থিতির কোনো দিন পরিবর্তন হবে না। তাই প্রতিবাদের উচ্চকণ্ঠ ম্রিয়মাণ হবে হতাশায়। রাজনৈতিক দলগুলো শুধু ক্ষমতা আঁকড়ে ধরবে, নিজেরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করবে এবং একটা পর্যায়ে তাদের ক্ষমতা থাকবে না। কিন্তু অন্য দলটি এসে তেমন কোনো পরিবর্তনের পথ দেখাবে না। অতীতে যারা ক্ষমতায় ছিল তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই শুধু সংগ্রাম করে। কিন্তু মানুষের কল্যাণের কথা বলে না। আর বললেও মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয় না। তাই রাজনৈতিক দলের প্রতি মানুষের আস্থা কমে গেছে। কোনো আশার আলো তারা দেখতে পায় না। এই পরিস্থিতি থেকে নাগরিক চেতনার উন্মেষ না ঘটলে কোনো আশার আলো দেখাও যাবে না। শুরুটাই হচ্ছে তার অধিকার চেতনা।

লেখক: মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ