হোম > ছাপা সংস্করণ

নায়ক খুনের মামলা গুম

আশরাফ-উল-আলম ও এস এম নূর মোহাম্মদ, ঢাকা

নায়ক-শিল্পপতি-সন্ত্রাসী। দৃশ্যপটে হাজির সবাই। সিনেমার গল্প জমে ওঠারই কথা। খুন হয়ে গেলেন নায়ক। মামলা হলো। কোর্ট-কাচারি আর আইনের হাত ঠেকাতে এবার সক্রিয় সবাই। একসময় যেন গায়েব হয়ে গেল পুরো মামলা, জানল না কেউই।

ঢালিউডের নায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার গল্প এটা। তবে ঘটনার সবটাই বাস্তব। নায়ক সোহেল চৌধুরী খুন হন ১৯৯৮ সালে। ২৩ বছর পর খোঁজ নিতে গিয়ে মনে হচ্ছে, পেছন থেকে কেউ পুরো মামলাটি গুম করে দিয়েছে।

সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার বিচার চলার সময় এক আসামি নিম্ন আদালতের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে  ২০০৩ সালের ১৯ নভেম্বর একটি রিট (৭০৫৩/২০০৩) করেন। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সেই রিট আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিচার স্থগিত করে দেন। এরপর যথারীতি রিটটি নিষ্পত্তি হয়, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশও প্রত্যাহার হয়। কিন্তু সেই প্রত্যাহারের আদেশ সাত বছরেও আর নিম্ন আদালতে পৌঁছায়নি। মাঝপথে গায়েব হয়ে যায়। সে কারণে আটকে গেছে বহুল আলোচিত এই হত্যা মামলার বিচার।

হাইকোর্ট ও নিম্ন আদালতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই মামলার আসামির তালিকায় একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী আছেন। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁদের প্রভাবে বিচারকাজ থামিয়ে দিতে উচ্চ আদালতের নথি গায়েব করা হয়েছে।

রাজধানীর বনানীর ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান ছিলেন চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী। ১৯৯৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে বনানীর ক্লাব ট্রামসের নিচে গুলি করে হত্যা করা হয় তাঁকে। তাঁর বড় ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ মামলাটি তদন্ত করে। শুরুতে ক্লাবের ১১ সদস্য-কর্মচারীকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে। ঘটনাস্থল থেকে আটক করা হয় আদনান সিদ্দিকি নামের এক ব্যক্তিকে। ডিবি পুলিশ তদন্তে নেমে ১৯৯৯ সালের ৩ জানুয়ারি গুলশান থেকে ক্লাব ট্রামসের মালিক বান্টি ইসলামকে গ্রেপ্তার করে। এর তিন দিন পর ৬ জানুয়ারি গুলশান লেডিস পার্কের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আলোচিত শিল্পপতি আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আদনান সিদ্দিকি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, হত্যাকাণ্ডের আগে এক শিল্পপতির ফোন পেয়ে তিনি ঢাকা ক্লাব থেকে ঘটনাস্থলে যান।

এক বছর তদন্তের পর ১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই ডিবি পুলিশের সহকারী কমিশনার আবুল কাশেম ব্যাপারী নয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। এতে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ছাড়াও তারিক সাঈদ মামুন, সেলিম খান, হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন, ফারুক আব্বাসী, আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনকে অভিযুক্ত করা হয়।

২০০১ সালের ৩০ অক্টোবর এই মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়। এরপর বিচারের জন্য পাঠানো হয় ২ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। কিন্তু মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আসামি আদনান সিদ্দিকি ২০০৩ সালের ১৯ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের বেঞ্চ ২০০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রুলসহ আদেশ দেন। এতে বলা হয়, রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম নিম্ন আদালতে স্থগিত থাকবে।

এরপর প্রায় ১২ বছর মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত থাকে। বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর বেঞ্চ শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট রায় দেন। রায়ে রুলটি খারিজ করে দেওয়া হয়। হাইকোর্টের দেওয়া স্থগিত আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এতে মামলার বিচার কার্যক্রম চলতে আইনত আর কোনো বাধা থাকে না। আদালতের আদেশ নিম্ন আদালতে পাঠাতে বলেন হাইকোর্ট। কিন্তু সেই আদেশ আর নিম্ন আদালতে পৌঁছায়নি। ধারণা করা হয়, মাঝপথেই তা হারিয়ে গেছে।

ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এ খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সাত বছর আগের হাইকোর্টের রায়ের আদেশ সেই মামলার মূল নথিতে নেই। জানতে চাইলে ট্রাইব্যুনালের বেঞ্চ সহকারী ও কর্মচারীরা আজকের পত্রিকাকে বলেন, হাইকোর্টের কোনো রায় তাঁরা পাননি। এত দিনে কেউ এ মামলার খোঁজ নিতেও আসেননি। ট্রাইব্যুনালের দৈনন্দিন কার্যতালিকা থেকে দেখা যায়, স্থগিতাদেশের পর মামলার আর কোনো শুনানিও হয়নি।

মামলার নথি থেকে দেখা যায়, এই মামলার নয় আসামির মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন ও তারিক সাঈদ মামুন অন্য মামলায় কারাগারে আছেন। গত বছরের ৩১ মার্চ মামলার আরেক আসামি ফারুক সরকার আব্বাসীকে কুমিল্লা পুলিশ ঢাকার রায়েরবাজার থেকে গ্রেপ্তার করে। তিনি আগে থেকেই জামিনে ছিলেন। এ নিয়ে দুজন ছাড়া সব আসামিই জামিনে আছেন।

ঢাকা মহানগর পিপি আবু আবদুল্লাহ বলেন, সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে আছে। ওই ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি এ সম্পর্কে বলতে পারবেন। ট্রাইব্যুনালের বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি (স্পেশাল পিপি) শামসুল হক বাদল আজকের পত্রিকাকে বলেন, হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিত মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। ওই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়েছে, এমন কোনো খবর তাঁর জানা নেই।

এরপর রায়ের হদিস জানতে আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে হাইকোর্টের বিভিন্ন শাখায় খোঁজ নেওয়া হয়। সেখানে দেখা যায়, রায়টি ছিল ছয় পাতার। স্বাক্ষর শেষে সেটা আদালত থেকে ২০১৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রিট শাখায় পাঠানো হয়। শাখা থেকে ওই নথি বিচারিক আদালতে পাঠানোর জন্য প্রক্রিয়া করতে ৫ অক্টোবর দেওয়া হয় টাইপরাইটার মাহফুজুর রহমানের কাছে। কাজ শেষ করে ১৮ অক্টোবর মাহফুজ সেটা আবারও শাখায় ফেরত দেন। যেখানে লেখা রয়েছে, দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এ পাঠানো হলো। মাহফুজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নথিটি যে শাখায় ফেরত দিয়েছেন এমন রেকর্ড দেখান। তবে তাঁর পাঠানোর পর থেকে নথির আর কোনো রেকর্ড নেই হাইকোর্টে। কারও কাছ থেকেই এই বিষয়ে কোনো তথ্যও পাওয়া যায়নি।

হাইকোর্টের নিয়ম অনুসারে, এ ধরনের নথি সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালতে যাওয়ার কথা। আর সংরক্ষণের জন্য পাঠানোর কথা রেকর্ড শাখায়। তবে ওই নথি বিচারিক আদালতে গেছে এমন কোনো তথ্য দিতে পারেননি জারি শাখার সংশ্লিষ্টরা। সেখানে কর্মরত সুফিয়ান নামের এক ব্যক্তি বলেন, নিষ্পত্তির পর অবশ্যই নিম্ন আদালতে রায়ের নথি চলে যাওয়ার কথা। তবে এটি জারি হওয়ার কোনো প্রমাণ নথি খুঁজে দিতে পারেননি তিনি।

এদিকে রেকর্ড শাখায় এই নথি গেছে এমন তথ্যও দিতে পারেননি ওই শাখার কর্মীরা। রেকর্ড শাখার সুপার এরফান মিজি আজকের পত্রিকাকে বলেন, এ ধরনের কোনো নথি তাঁর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে বলে রেকর্ডে নেই। কোনো কারণে মামলা নিষ্পত্তি না হলে সেই নথি রাখা হয় পেইন্ডিং-এ। সেই পেইন্ডিং দপ্তরেও খোঁজ নেওয়া হয়। সেখানে খোঁজ করে নথি না পাওয়ার কথা জানান ওই দপ্তরে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা শাহজাহান।

সাধারণত কোনো আদেশ বা রায় হলে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে এর তথ্য থাকে। এই মামলার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে আদেশের স্থানে লেখা রয়েছে ‘নো ফাইল আপডেট’। জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র সাইফুর রহমান বলেন, ‘নথি পাওয়া না গেলে আমি কী করব।’

এই মামলার আসামি তারিক সাঈদ মামুনের আইনজীবী সৈয়দ আহমেদ গাজী আজকের পত্রিকাকে বলেন, হাইকোর্টে মামলার কার্যক্রম স্থগিত হওয়ার কারণে সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি। এই মামলায় মামুন জামিনে আছেন। তবে তাঁর বিরুদ্ধে অন্য মামলা থাকায় এই মামলায় তাঁকে হাজতি পরোয়ানা দিয়ে আটক রাখা হয়েছে। কিন্তু স্থগিতাদেশ থাকায় তিনি বিচারিক ট্রাইব্যুনালে কোনো আবেদন করতে পারছেন না। হাইকোর্টে রিট আবেদন নিষ্পত্তি করে রায় হয়েছে কি না সে বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান এই আইনজীবী।

আইনজীবীরা বলছেন, এই মামলায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ও প্রভাবশালীরা জড়িত আছেন। আর যেভাবে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে তাতে একপর্যায়ে মামলার সাক্ষীদের আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আবার জব্দকৃত আলামতও নষ্ট হয়ে যাবে। এতে করে মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব হবে না। আদেশ গায়েব করার কাজটি মামলা ও বিচার বিলম্বিত করার কৌশল হতে পারে বলে তাঁদের সন্দেহ।

সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার বাদী তাঁর বড় ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এমন আলোচিত মামলার ক্ষেত্রেও যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে বলতে হবে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছু হতে পারে না।’

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ