হোম > ছাপা সংস্করণ

টাকার বিনিময়ে নেতৃত্ব নির্বাচন

চিররঞ্জন সরকার

একসময় ছাত্ররাজনীতি ছিল ত্যাগ, প্রতিবাদ ও সংগ্রামের প্রতীক। কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেওয়া, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য ছাত্রসংগঠনগুলো সব সময় সোচ্চার থাকত। অন্যায়কারী ও জুলুমবাজেরা তাই এই ছাত্রদের ভয় পেত। সমীহ করত।

১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর ছাত্ররাজনীতির এই ধারা বদলে গেছে। ক্ষমতার মধুর লোভে সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলের সমর্থক ছাত্রসংগঠনের জয়জয়কার শুরু হয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রদল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রলীগ—এই ধারাবাহিকতাই চলে আসছে তিন দশক ধরে।

আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে প্রায় ১৪ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একক আধিপত্য কায়েম করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তারা বিকল্প প্রশাসন চালু করেছে। হলগুলোতেও তাদের একক নিয়ন্ত্রণ। কে সিট পাবে, কে কোন রুমে থাকবে—সব ঠিক করে ছাত্রলীগ। ফাউ খাওয়া, বিভিন্ন দোকান থেকে বখরা নেওয়া, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি—সবকিছুর দায়িত্ব তারাই পালন করে। এই একক নিয়ন্ত্রণ শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, ছাত্ররাজনীতিতেই এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। যার প্রকাশ ঘটছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

ছাত্রলীগে নাম লেখানো এখন ‘লাভজনক ব্যবসা’র লাইসেন্স পাওয়া। চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির অবাধ সুযোগ পাওয়া যায়। আধিপত্য বিস্তার ও ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে তারা নিজেরাই সংঘর্ষে জড়ায়। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ এখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে।

অথচ এই সংগঠনের রয়েছে গৌরবময় অতীত। ছাত্রলীগ বর্তমানে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিন্তু এই ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার এক বছর আগে। প্রতিষ্ঠার পর ৬ দফা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনসহ বাংলাদেশের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রলীগ গৌরবোজ্জ্বল ও সাহসী ভূমিকা পালন করেছে।

এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯৮১ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এলে দল পুনর্গঠনের লড়াইয়ে ছাত্রলীগ ছিল মূল শক্তি। কিন্তু গত দেড় দশকে ছাত্রলীগ তার গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে মুছে দিয়ে দলের জন্য দায় হয়ে উঠেছে; বিশেষ করে গত ১৪ বছরে এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা করেননি। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অপহরণ, কমিটি-বাণিজ্য, খুন, ধর্ষণ, হল দখল, ক্যাম্পাস দখল, সাধারণ ছাত্রদের হয়রানি, এমনকি ঠান্ডা মাথায় খুনের অভিযোগও রয়েছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে; বিশেষ করে পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ আর বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যার মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনা ম্লান করে দিয়েছে ছাত্রলীগের যাবতীয় অর্জনকে।

কয়েক বছর ধরে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা অবাধে কমিটি-বাণিজ্য শুরু করেছেন। বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও শাখা কমিটিতে পদ পাইয়ে দিতে বড় অঙ্কের চাঁদা নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে জেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে এক নেতাকে পদ পাইয়ে দেওয়ার নামে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতা আতিকুল ইসলাম আতিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পাইয়ে দেওয়ার নামে প্রায় আড়াই লাখ টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন পদপ্রত্যাশী এক নেতা। ৯ নভেম্বর চাঁদা চাওয়াসংক্রান্ত কথোপকথনের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।

ত্যাগী আর পরিচ্ছন্নদের বাদ দিয়ে টাকার বিনিময়ে অছাত্র, মাদকসেবী ও বিবাহিতদের দিয়ে পিরোজপুর জেলা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সংগঠনটির জেলা কমিটির সাবেক ও বর্তমান নেতারা। সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা এই অভিযোগ করেন।

ছাত্রলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ প্রায়ই উঠছে। এর আগে যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক হাবিবুর রহমান এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি-সম্পাদক শোভন-রাব্বানীদের বিরুদ্ধে কমিটি-বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছিল। কমিটিতে পদ দেওয়ার নাম করে তাঁরা কোটি কোটি টাকা ইনকাম করেছেন বলে অভিযোগ আছে। এমন অভিযোগের কারণে তাঁদের পদচ্যুত করা হয়।

শোভন-রাব্বানীদের সরিয়ে দেওয়া হলেও পদ বা কমিটি-বাণিজ্য বন্ধ হয়নি; বরং তা এখন প্রায়ই গণমাধ্যমে উঠে আসছে। এমন অভিযোগে ক্ষুব্ধ হয়ে কিছুদিন আগে দলের নেতাদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘আপনারা দলটাকে বাঁচান। টাকাপয়সার লেনদেন—এগুলো বন্ধ করেন। কমিটি করতে টাকা লাগবে, এটা বিএনপির হতে পারে, আওয়ামী লীগ এ চর্চা করতে পারে না। টাকাপয়সা নিয়ে মনোনয়ন—এ চর্চা চিরতরে বন্ধ করতে হবে। এটা শেখ হাসিনার নির্দেশ।’

কিন্তু এই ‘নির্দেশ’ কেউ মানছে না। মানার কথাও নয়। চান্দাবাজি-ধান্দাবাজি করে যদি টাকা আসে, বড়লোক হওয়া যায়, তাহলে নীতিকথা শুনে ঠকবে কোন আহাম্মক? চোর কি কখনো ধর্মের কাহিনি শোনে?

এরই মধ্যে আকস্মিক আগামী ৮ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে নতুন করে কোনো জেলা, উপজেলা কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি গঠন করতে ছাত্রলীগকে নিষেধ করা হয়েছে। এটা নাকি খোদ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ। কিন্তু এতে কি সমস্যার সমাধান হবে? এই সিদ্ধান্তের কারণে সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ভাতে মারা পড়বেন না?

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন মানে তো দেশব্যাপী সাজ সাজ রব। ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা, জেলা, শহর এবং বিভাগীয় এসব সম্মেলনে তুমুল উৎসাহ-উদ্দীপনা। শত শত নেতা, হাজার হাজার কর্মী। এখন তো দেশের সাবেক-বর্তমান সব শিক্ষার্থীই প্রায় ছাত্রলীগ। ক্ষমতার মধুর স্বাদ পেতে মৌমাছির কোনো অভাব নেই!

কমিটিতে স্থান পেতে সবাই মরিয়া। ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা বাছাই করতেও হিমশিম খেতে হয়। এ অবস্থায় পদ-বাণিজ্যের বিষয়টি একটি নীতিমালার আওতায় আনলে আওয়ামী লীগের জন্য সুফল বয়ে আনত। আওয়ামী লীগ বরং টাকার বিনিময়ে কমিটিতে স্থান পাওয়ার ব্যাপারটিকে বৈধ করে দিতে পারে।

এ ব্যাপারে কিছু ক্যাটাগরি করা যেতে পারে। যেমন ওয়ার্ড কমিটির সাধারণ সদস্যের জন্য ন্যূনতম তিন লাখ টাকা। সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হওয়ার জন্য ন্যূনতম পাঁচ লাখ টাকা। আর সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের জন্য দশ লাখ। এই টাকার টোয়েন্টি পার্সেন্ট পাবে থানা কমিটি। টেন পার্সেন্ট জেলা কমিটি। থানা ও জেলা কমিটির নেতারা এই টাকা সমভাবে ভাগ করে নেবেন। বাকিটা পাবে কেন্দ্রীয় কমিটি।কেন্দ্রীয় কমিটি চাইলে এই টাকা দল পরিচালনায় ব্যয় করবে। চাইলে নিজেরাও কিছু অংশ পকেটস্থ করতে পারে।

কমিটিতে স্থান পাওয়ার জন্য আরও কিছু ক্যাটাগরি থাকতে পারে: যেমন বিএনপি থেকে যারা আসবে, তাদের জন্য দশ লাখ। জামায়াত থেকে যারা আসবে, তাদের জন্য পনেরো লাখ। সিপিবি-জাসদ-গণফোরাম মার্কা দল থেকে যারা আসবে, তাদের জন্য তিন লাখ।

নিষ্ক্রিয়রা যদি কমিটিতে আসতে চায়, তাদের জন্য এক লাখ। আর যারা চিহ্নিত চাঁদাবাজ, মাস্তান, তাদের জন্য বিশ লাখ! এভাবে একটা নিয়মের মধ্য দিয়ে কমিটিগুলো গঠন করলে ঝামেলা অনেক কমবে। যারা প্রয়োজনীয় টাকা দিতে পারবে না, তারা কর্মী হিসেবে ভূমিকা পালন করবে।

আসলে ক্ষমতাসীন দল ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাদের যতই নির্দেশনা দেওয়া হোক না কেন, নানা প্রক্রিয়ায় তাঁরা টাকা বানাবেনই। এটা রোধ করা যাবে বলে মনে হয় না। এখন শুরুতেই যদি নিয়মের মধ্য দিয়ে ‘টাকার বিনিময়ে নেতৃত্ব নির্বাচন’ করা হয়, তাহলে অন্তত কিছু টাকা বৈধভাবে দলের ফান্ডে যাবে এবং তুলনামূলকভাবে একটু বড় নেতারা কিছু ভাগ পাবেন। আর টাকার অভাবে কিছু লোক নেতৃত্বের ভিড় থেকে সরে দাঁড়াবেন! প্রস্তাবটা ক্ষমতাসীনেরা ভেবে দেখতে পারেন।

 

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ