পরিচালক শালিকটাকে খাঁচায় বন্দী করেছিলেন, নাকি খাঁচায় বন্দী অবস্থায় দেখিয়েছেন? নিশ্চয়ই জবাব দ্বিতীয়টি। চিত্রনাট্যের স্বার্থে তিনি এটা করেছেন। তার মানে কী এই যে, তিনি বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ লঙ্ঘন করেছেন?
‘হাওয়া’ সিনেমার ট্রেইলার চুম্বকের মতো হলে টানছিল। মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই হাউসফুল। সব শ্রেণির দর্শকের উপচে পড়া ভিড়। টিকিট পাওয়া সহজ নয়। চার সপ্তাহ ধরে অর্ধশতাধিক হলে যখন একই জনপ্রিয়তায় একইভাবে ছবিটি প্রদর্শিত হচ্ছিল এবং সবার মুখে মুখে ছবিটি প্রশংসিত হচ্ছিল একটি সুস্থ চলচ্চিত্র হিসেবে, ঠিক তখনই হাওয়া ছবিটি ‘শালিক’ বিতর্কে জড়িয়ে গেল। এই বিতর্ক কেবল কথার মধ্যে আটকে থাকল না, চলে গেল আদালত পর্যন্ত এবং তা বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে। মামলাবাজ হলেন স্বয়ং বন্য প্রাণী সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একজন সচেতন বন্য প্রাণীপ্রেমী।
হাওয়া সিনেমার পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন তাঁর সৃষ্টির জন্য সবার প্রশংসা পেলেও বন্য প্রাণীপ্রেমীর আইনি অজুহাতে ধরা খেলেন, কঠিনভাবে সমালোচিত হলেন। রীতিমতো কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ব্যবস্থা করা হলো। অভিযোগ হলো, পরিচালক সুমন একটি শালিককে তাঁর ছবিতে খাঁচায় বন্দী করে রেখেছিলেন এবং একপর্যায়ে ছবির চরিত্র চান মাঝি সেই শালিককে পুড়িয়ে খেয়েছেন। ব্যস, পরিচালক সুমনের বিরুদ্ধে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ লঙ্ঘনের অভিযোগে হয়ে গেল ২০ কোটি টাকার মামলা।
এই মামলার আগপর্যন্ত জানা ছিল না যে এমন বন্য প্রাণীপ্রেমী কেউ আছেন অধিদপ্তরে। কারণ, এ রকম একটা অধিদপ্তর থাকা সত্ত্বেও প্রায়ই সংবাদে প্রকাশিত হতে দেখা যায় যে প্রভাবশালীদের দ্বারা গাছ কেটে বন উজাড় হচ্ছে। এতে পাখিসমাজ ঠিকানাহারা হচ্ছে। বন থেকে বন্য প্রাণী লোকালয়ে চলে আসে। হরিণের মাংস ও চামড়া উপহার হিসেবে বিশেষ জায়গায় চলে যায়। সাপ ধরে নিয়ে সাপুড়েরা জীবিকা নির্বাহ করে। কাঁটাবনে সারিবদ্ধ দোকানে পশুপাখির ব্যবসা চলে। এ ছাড়া, কোভিডকালীন চিড়িয়াখানায় পশুপাখিরা না খেয়ে থাকার কথাও শোনা গেছে। আরও কত-কী যে শোনা যায়! কখনো পশুপাখির জন্য কেউ আদালত পর্যন্ত গিয়েছেন কি না, জানা নেই। কিন্তু মেজবাউর রহমান সুমনের বেলায় এমনটা ঘটেছে।
মানুষের মতো প্রাণীরও অধিকার আছে। অধিকার সংরক্ষণ আইন আছে। অনেকে না জেনে থাকলেও এ ঘটনার মাধ্যমে তা জেনেছেন। এটা কিন্তু কম নয়।
প্রায়ই মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ সব ক্ষেত্রে হয়ও না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি আইনের মাঝেই দিব্যি ডালপালা মেলে থাকে। এমন অবস্থায় সুমনের বিরুদ্ধে করা এই মামলা সম্ভবত দেশে প্রথম। হাওয়া সিনেমা নিয়ে সাংঘাতিক সব প্রশংসার মাঝে এই সাংঘাতিক অপরাধটা কেমন যেন বিসদৃশ ঠেকল। কানায় কানায় দর্শক ভর্তি হলে গিয়ে তাই ছবিটা দেখতেই হলো। পিনপতন নীরবতায় ছবি উপভোগ করলাম। কাহিনি, নির্দেশনা, চিত্রায়ণ, সম্পাদনা, অভিনয়, সংলাপ, আবহ সংগীত, পোশাকপরিচ্ছদ, আসবাব, লোকেশন সব যেন পর্দায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সবার পারফরম্যান্স দেখে মনে হয়নি তাঁরা অভিনয় করছেন। এমনকি শালিককেও মনে হলো একজন অভিনয়শিল্পী। কাহিনির স্বার্থে পরিচালক চিত্রনাট্যে শালিককে সেভাবে উপস্থাপন করেছেন, যেমন উপস্থাপন করেছেন চঞ্চল চৌধুরীকে চান মাঝি হিসেবে। শরীফুল রাজ, তুষিসহ সবাই। ছবির পুরোটা সময়ে মনে হচ্ছিল, সমুদ্রের মাঝে একটা মাছধরার ট্রলারে বসে কিছু মানুষের জীবন দেখছি। যে জীবনের গল্প অনেকেরই হয়তো জানার সুযোগ থাকে না। পরিচালক ও বাকি শিল্পীদের যা কিছুই করতে হয়েছে, সবই গল্পের প্রয়োজনে। অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পরিচালক তাঁর প্রয়োজন মিটিয়েছেন। এখানেই তাঁর সার্থকতা।
পরিচালক সুমন বলেছিলেন, শালিককে তিনি সমুদ্রের মাঝে কাজ শেষে ছেড়ে দিয়েছেন। এবং সেই শালিককে নয়, একটি ছোট মুরগি পোড়ানো হয়েছে গল্পের প্রয়োজনে। যেটা দেখে মনে হবে শালিক পোড়ানো হয়েছে। যেমন, আমরা কোনো কোনো সিনেমায় নায়ককে বড় বড় অট্টালিকা থেকে লাফ দিতে দেখি। দর্শক হাততালি দেন তা দেখে। ভাবেন, নায়কের অনেক সাহস। অথচ সেই দৃশ্যটিতে নায়ক নন, নায়কের আদলে অভিনয় করেন অন্য শিল্পী। ছবিতে এ রকম ডামি শুট থাকে প্রচুর। দক্ষতার সঙ্গে পরিচালক সেসব চিত্রায়ণ করেন। অভিযোগকারীরা ছবি নির্মাণের কৌশল সম্পর্কে সম্ভবত সেভাবে অবগত নন। আবার সুমনের কথায় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা দাবি করেছেন, শালিককে মাঝসমুদ্রে ছেড়ে দেওয়ায় শালিক তার ঠিকানা হারিয়েছে। হয়তো। কিন্তু তার কথায় চোখের সামনে ভেসে ওঠে, হাজার হাজার পথশিশুর চেহারা। নদীভাঙন আর বন্যায় ভিটেমাটি হারানোর মানুষের জীর্ণ দেহ। সিডর, আইলা, আম্পানের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ঠিকানা হারানোর কথা। আর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বহীনতায় প্রতিবছর কতশত বাংলাদেশি যে অভিবাসনের আশায় সমুদ্রে বিলীন হন। বন্যা ও নদীভাঙন রোধে বছর বছর বাঁধ নির্মাণ কিংবা সংস্কারে টাকা বরাদ্দ থাকলেও তার বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য কারও দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহি কিন্তু থাকে না। এ জন্য কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ব্যর্থতার জন্য অনুশোচনা করতে হয় না।
সুমনের বিরুদ্ধে অভিযোগের সময় আরও একটি সংবাদ প্রচারমাধ্যমে আসে। সেটা হলো, লঘুচাপের সংকেত আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছ থেকে যথাসময়ে না পাওয়ায় ২০টি মাছ ধরার ট্রলার সমুদ্রে ডুবে যায়। এতে অনেক মাঝি নিখোঁজ ও হতাহত হন। এ জন্য কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ওঠেনি। মামলাও হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে এক শালিক নিয়ে ২০ কোটি টাকার মামলা বিস্ময় তৈরি করে বৈকি।
রিয়েলিস্টিক ফিল্ম বা আর্ট ফিল্ম এমনভাবে নির্মাণ করা হয়, যেখানে বাস্তবতাকে হুবহু তুলে ধরা হয়। ফ্যান্টাসির কোনো সুযোগ সেখানে থাকে না। সুমনের ছবিকে আমার তেমনই মনে হয়েছে। তিনি কোনো কিছুর সঙ্গেই আপস করেননি। প্রশ্ন হলো, পরিচালক শালিকটাকে খাঁচায় বন্দী করেছিলেন, নাকি খাঁচায় বন্দী অবস্থায় দেখিয়েছেন? নিশ্চয়ই জবাব দ্বিতীয়টি। চিত্রনাট্যের স্বার্থে তিনি এটা করেছেন। তার মানে কী এই যে, তিনি বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন, ২০১২ লঙ্ঘন করেছেন? কোনো কোনো ছবিতে মাদক ব্যবহার ও ব্যবসা, খুন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন দণ্ডনীয় অপরাধ দেখানো হয়, সেসব নিয়ে কিন্তু কোনো পরিচালকের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে মামলা হতে দেখা যায়নি। আর কোন ছবি প্রদর্শনযোগ্যতা পাবে, তা যাচাই করার জন্য সেন্সর বোর্ড রয়েছে। সেন্সর বোর্ডকে সব আইন, রাষ্ট্রের স্বার্থ বিবেচনা করতে হয়। বোর্ডের হাত থেকে ভুল ও অন্যায় কিছু ছাড় পেলে তার দায় তো তাদেরও, একা পরিচালকের কেন হবে?
আইন প্রয়োগ হোক সঠিক জায়গায় এবং বিচক্ষণতায়। এমন কিছু কেউ না করি যেন কেবল বিস্মিত হতে হয় এবং বলতে হয়, ‘আজব তো’! যখন লেখাটা শেষ করলাম, দেখলাম বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় সুমনের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেছে।
স্বপ্না রেজা, কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক