আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবসের অন্যতম ভাবনা হচ্ছে, আধুনিক তথ্যব্যবস্থায় বিশেষ করে ডিজিটাল তথ্যের ব্যবহারে একজন নাগরিককে কীভাবে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা যায়। তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার জনগণের মৌলিক অধিকারগুলোর একটি। কিন্তু ডিজিটাল তথ্যের অধিকার কি আমাদের দেশের জনগণ আইনগতভাবে অর্জন করেছে? এদিকে একইভাবে ডিজিটাল তথ্যে জনগণের অধিকার এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁদের তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ বৃদ্ধির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে।
ডিজিটাল তথ্য ব্যবহারে এক ব্যক্তির নিজস্ব তথ্যের গোপনীয়তা এবং প্রতিটি দপ্তর কিংবা অফিসের ডিজিটাল তথ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স—এআই) যথেচ্ছ অনুপ্রবেশ সার্বিক তথ্যব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
আমাদের সমাজে আধুনিক প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট ব্যবহারের বাস্তবতা বড় ধরনের সামাজিক ব্যবধান সৃষ্টি করেছে। বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল ডিভাইড কম-বেশি একই রকম প্রশ্নের অবতারণা করেছে। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম কিছু নয়, বরং এই ব্যবধান অনেক বেশি। এদিকে সুশাসন নিশ্চিত করা, জনগণের অধিকার রক্ষা এবং এআইয়ের প্রভাব থেকে নৈতিক দিক অক্ষুণ্ন রেখে জনগণকে সেবা প্রদান করা—তথ্য অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে এই তিনটি বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এই বিষয়গুলো অধিক গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনার দাবি রাখে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সুশাসন কীভাবে নাগরিকের তথ্যে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে পারে, সে ব্যাপারে অভিজ্ঞ মহলের কাজের অবকাশ রয়েছে। পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সুশাসন তথ্য অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করবে না—এই মর্মে তার প্রতিবিধান করা। আধুনিক প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কাজকর্ম সম্পন্ন হয়, সে ক্ষেত্রে সেই সব প্রতিষ্ঠান সরকারি কাজের ধ্যানধারণা ও নিয়মকানুন পুরোপুরি মেনে চলে না, আদর্শিকভাবে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে। এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক তথ্যের ওপর এআইয়ের ব্যবহার নৈতিকভাবে পরিপালিত না-ও হতে পারে, বরং এআইয়ের অনৈতিক অনুপ্রবেশ তথ্য ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। তাহলে আউটসোর্সিংয়ের কাজকর্ম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অবাধ সঞ্চরণ যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কাজে যেভাবে অনুপ্রবেশ করে তথ্য-উপাত্তের ওপর নিজের প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে, তাতে সেই সব তথ্য-উপাত্তের মৌলিকত্ব এবং তার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হবে।
আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস পালন উপলক্ষে ২৮ সেপ্টেম্বর তাসখন্দে সমবেত হওয়ার কথা শতাধিক সদস্যদেশের। সেই সমাবেশে তাসখন্দ ঘোষণা গৃহীত হবে বস্তুতপক্ষে সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে জনগণের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি হিসেবে তাদের প্রতিশ্রুতি জনগণের তথ্য অধিকার কার্যকরভাবে প্রতিপালনের লক্ষ্যে। সেই ঘোষণায় ১২টি প্রধান সুপারিশ সন্নিবেশিত হয়েছে। সুপারিশগুলো আবর্তিত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাম্প্রতিক প্রযুক্তির উদ্ভব ও সুশাসনকে ঘিরে। জীবনমানের এই ত্রিমাত্রিক বাস্তবতাকে ঘিরে জনগণকে অবাধ তথ্যপ্রবাহের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষের মধ্যে উন্মুক্ত জীবনাচারের অন্যতম বাহন হিসেবে তথ্য ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে হবে। তাতে করে আইনের শাসন নিশ্চিত হবে; প্রশাসনে স্বচ্ছতা আসবে এবং জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত হবে। এই সুপারিশসমূহের মধ্যে বয়স্ক, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন, গ্রামের মানুষ, ডিজিটাল সীমিত সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি, নিম্ন আর্থসামাজিক ব্যক্তিবর্গের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
দ্রুত ও স্বল্প সময়ে যোগাযোগ স্থাপন, মতামত আদান-প্রদান এবং দুর্লভ তথ্য ও যোগাযোগ উপকরণপ্রাপ্তির যে সুযোগ ও সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, তা অকল্পনীয় এক তথ্যভান্ডার।
তথ্য অধিকার আইন জনগণের জন্য একধরনের রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত হয়। যদি প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান, কার্যালয়, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড, পরিকল্পনা, সেবা ইত্যাদি সম্পর্কে কোনো নাগরিক কিছু জানতে চায়, তাহলে তথ্য অধিকার আইনের আওতায় সে প্রার্থিত তথ্য পেতে পারে।
নিয়ম অনুযায়ী তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার ভোগ করার জন্য নামমাত্র মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে একজন নাগরিক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা পেয়ে থাকে। তাতে করে পুরো প্রশাসনযন্ত্র জবাবদিহির মধ্যে চলে আসে। যেকোনো সময় যেকোনো নাগরিক যেকোনো অফিসে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য চাইতে পারে এবং পেতে পারে। তাতে করে তথ্য লুকানোর সংস্কৃতি থেকে এই সমাজ বেরিয়ে আসতে পারে। তথ্যের অংশীদারত্বে নতুন সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে। দীর্ঘকাল মনে করা হতো, কোনো অফিসের তথ্য হয়তো গোপনীয়; তথ্য যে নাগরিকদের জন্যই ব্যবহার করা হয়, তথ্য জেনে নাগরিকের জীবনমান যে পরিবর্তন করা সম্ভব— এই সুযোগই ছিল না। তথ্য অধিকার আইন চালু হওয়ার পর জনগণের সাংবিধানিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। সংবিধানের ৭ (১)-এ রয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ’। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই সংশ্লিষ্ট আইনের প্রয়োগ একটি মাইলফলক ঘটনা। তথ্য কবজা করে তা প্রকাশ না করার যে অবস্থা বিদ্যমান ছিল, তা থেকে বের হয়ে জনগণের সুবিধার জন্য তথ্য ব্যবহার করার আইনি ব্যবস্থা দেশের মানুষকে একটি দায়িত্বশীল অধিকার চর্চার সুযোগ করে দিয়েছে।
ইউনেসকো গত বছর তথ্য অধিকারে জনগণের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার প্রত্যয় ঘোষণা করে এসডিজির ১৬.১০.২ নিরূপণে আইন প্রণয়ন ও কার্যকরণে মানসম্পন্ন ‘টুল’ বা হাতিয়ার বলে অভিহিত করেছে। ইউনেসকো সরকারি ও সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলোকে উচ্চমানসম্পন্ন, সময়োপযোগী, বিশ্বাসযোগ্য তথ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সহায়তা প্রদানের কথা উল্লেখ করেছে।
তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ সরকারি ও বেসরকারি অফিস থেকে তথ্যপ্রাপ্তি দেশের নাগরিকদের জন্য এক অপরিমেয় শক্তি। এই শক্তি যথাযথভাবে কাজে লাগানোর জন্য তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ সম্পর্কে জনগণকে জানতে হবে। ভালোভাবে জানতে হবে আইনের ধারা-উপধারা এবং আইনটি ব্যবহার করার কৌশল। আইন সম্পর্কে এমনিতেই জনগণের ধ্যানধারণা খুব ভালো নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষের আইনের সুফল ভোগ করার প্রয়োজনীয়তা সাধারণভাবে হয়ে ওঠে না।
প্রেস তথা গণমাধ্যমকর্মীদের তথ্য অধিকার আইন প্রচারের কথা সম্যকভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। তাঁরা শুধু তথ্য অধিকার আইনের প্রচারেই সীমাবদ্ধ থাকবেন না, বরং নিজেরা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তথ্যের জন্য অনেক আবেদন করবেন, তাতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কাজের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্নীতি হ্রাস পাবে।
আধুনিক ও প্রযুক্তিবান্ধব আইনের প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধি করা এবং বিদ্যমান আইনের সংস্কার ও পরিবর্তন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করে ব্যক্তি ও সংস্থার তথ্য সংরক্ষণে আধুনিক ও সময়োপযোগী আইনের প্রবর্তন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তথ্যের ব্যবহার মানুষকে উন্নত জীবনমানের নিশ্চয়তা দেয়। মানুষ নানা তিক্ততায় ঘর পোড়া গরুর মতো সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পায়। তাদের আইনের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করে, আইন সম্পর্কে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: সম্পাদক, আজকের পত্রিক