হোম > ছাপা সংস্করণ

চেয়ার এবং মানুষ

স্বপ্না রেজা

চেয়ার কোনো কোনো ব্যক্তির ইতিবাচক গুণাবলিকে বিলুপ্ত করে, গ্রাস করে। কিংবা ইতিবাচক হতে দেয় না, বরং অহংকারী করে। প্রবল অহংবোধে ভাসায়। তারা চেয়ারের মূল্য দিতে শেখেও না, পারেও না।

যে এবং যারা কায়িক পরিশ্রম করে চেয়ার তৈরি করে থাকে, সে এবং তারা সাধারণত চেয়ারে বসার সৌভাগ্য অর্জন করে না। অনেক ক্ষেত্রেই এমনটি হয়।

তাদের তৈরি চেয়ারে অন্যরা বসে। আরাম করে, আয়েশ করে, কখনোবা অপরকে নিজের অবস্থান বুঝিয়ে দিতে বাহাদুরি করে। এমন বাহাদুর সংখ্যায় অনেক। সংখ্যা বাড়ে। বাহারি চেয়ার, রকমারি চেয়ার কেনার হীন প্রতিযোগিতাও সমাজে দেখা যায়।

অবশ্য চেয়ারে বসার জন্য তাদের ক্ষমতা থাকতে হয়। যেমন—চেয়ারে বসার জন্য টাকা খরচ করে কাঠমিস্ত্রি দিয়ে চেয়ার তৈরি করিয়ে নিতে হয় অথবা শোরুম থেকে পছন্দমতো চেয়ার কিনে নিয়ে তাতে বসতে হয়। অথবা প্রভাব খাটিয়ে চেয়ারে বসা হয়। এখানে টাকা ও প্রভাব হলো একধরনের সক্ষমতা। যার যত টাকা ও প্রভাব আছে, সে তত মূল্যবান চেয়ার ব্যবহার করে থাকে। পরিষ্কার যে, সমাজে একশ্রেণির মানুষ আছে, যারা অপরের বসার ব্যবস্থার জন্য কাঠমিস্ত্রির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং একপর্যায়ে এটাই তাদের পেশায় পরিণত হয়। আরেক শ্রেণির মানুষ আছে, যারা টাকা দিয়ে কাঠমিস্ত্রির শ্রম কেনার বদৌলতে চেয়ার নামক আসবাবের সন্ধান পায় এবং তা ব্যবহারের জন্য তৎপর হয়।

এভাবে চেয়ারের ব্যবহার ও প্রচলন প্রায় সবখানে ছড়িয়ে গেছে। সভ্যতার শুরু থেকে চেয়ার সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে এক প্রয়োজনীয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে।

তবে সত্যটা হলো, কাঠমিস্ত্রির তৈরি চেয়ারে বসে একজন ক্রেতা তার খাবার খেতে অভ্যস্ত হলেও সেই কাঠমিস্ত্রিকে কিন্তু মাটিতে বসেই খেতে দেখা যায়।

এতে কাঠমিস্ত্রির মনে কোনো ক্ষোভ, আফসোস কিংবা দুঃখ থাকে না। মানে, চেয়ারে বসতে না পারার কারণে কোনো ধরনের হতাশা সৃষ্টি হয় না। কিন্তু চেয়ার কেনা এবং চেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তির মনে একধরনের উন্নাসিকতা তৈরি হয়। চেয়ারে বসে সে ভাবতে পারে না যে একজন কাঠমিস্ত্রি মানুষ হিসেবে তার পাশে আরেকটি চেয়ারে বসতে পারে কিংবা তার সেই যোগ্যতা আছে। অথবা এই চেয়ার সেই কাঠমিস্ত্রিই তৈরি করেছে। উপরন্তু সে মিস্ত্রিকে তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির মানুষ ভেবে বসে এবং সেই অনুযায়ী দূরত্ব মেনটেইন করে। এটা কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম নয়, এটা সমাজের নিয়ম, যা সমাজে বসবাসকারী মানুষই তৈরি করে।

এই চেয়ারের ব্যবহার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সবখানে। পরিবারে পড়ার টেবিল, খাবারের টেবিল, ড্রয়িংরুমে চেয়ারের ব্যবহার অনেকটাই বাধ্যতামূলক।

পরিবারের সদস্যরা কষ্ট হলেও চেয়ার কেনে প্রয়োজন মেটাতে। এই চেয়ার আবার পরিবারের সদস্যদের অবস্থান নির্দিষ্ট করে দেয়। পরিবারে কে বেশি ক্ষমতাশালী, মর্যাদাসম্পন্ন সদস্য, সেটাও কিন্তু চেয়ার দ্বারা নির্ধারিত হয়। অনেক পরিবারের উপার্জনক্ষম পুরুষ সদস্য, যাকে কর্তা বলা হয়, তার জন্য একটা চেয়ার নির্দিষ্ট হয়ে যায়। পরিবারের কর্তাব্যক্তিটি সেই চেয়ারেই বসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এবং নিয়ম করে বসে যায়। সেই পরিবারে বেতনভুক্ত সদস্যরা কিন্তু ভুলেও ওই চেয়ারে বসতে পারে না এবং সেটা পরিবারের কঠোর বিধিনিষেধের কারণেই।

যাই হোক, পরিবারের মতো সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও চেয়ারের ব্যবহার ও ব্যবহারকারীদের সীমা ও ক্ষমতা নির্ধারিত। একটি প্রতিষ্ঠানের সর্বময় ক্ষমতাধারী ব্যক্তির চেয়ার নির্ধারণ করা থাকে। তার পছন্দ মোতাবেক তৈরি করা হয় কিংবা কেনা হয়। সেই সঙ্গে নির্ধারিত থাকে অন্যদের চেয়ারও। অন্যরা একে অন্যের চেয়ারে বসলেও ভুলেও সর্বময় ক্ষমতাধারীর চেয়ারে বসে না। বসলে সেটা হয় রীতিমতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলাভঙ্গের শামিল। প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে চেয়ার হলো সকল পর্যায়ের স্টাফদের কর্মযজ্ঞের পরিণতি। একটা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হলে তার অভ্যন্তরে অনেক ধরনের চেয়ারের প্রয়োজন হয়, যেখানে ক্ষমতা অনুসারে দায়িত্বশীলরা বসে কাজ করে। তার মানে হলো, প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে চেয়ার কর্মরত ব্যক্তির ক্ষমতাকে নির্দিষ্ট করে থাকে। অনেকটা কলমের ক্ষমতার মতো।

এমন নিয়ম সামাজিক প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য হলেও ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য হয় না। ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানে মালিক ব্যক্তির ইচ্ছাতেই সব হয়। আবার সামাজিক প্রতিষ্ঠান যখন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, তখন ব্যক্তির ইচ্ছা প্রতিষ্ঠানের চেয়েও বড় হয়ে যায়। তার বিলাপ, প্রলাপও নিয়ম হয়ে যায়। ভুলে যায়, সে যেই চেয়ারে বসে আছে বা বসতে পেরেছে, সেটা তাকে এনে দিয়েছে বা তৈরি করেছে তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সর্বস্তরের সদস্যরা। অনেকটা কাঠমিস্ত্রির শ্রমের আদলে। যাই হোক, চেয়ার সমাজে সব বৈষম্য তৈরির অন্যতম হাতিয়ার—কথাটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সত্যই বলা যায়।

দেখা যায়, রাষ্ট্রযন্ত্রেও দায়িত্ব অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের চেয়ার থাকে। চেয়ারে উপবিষ্ট হওয়ার পর ব্যক্তির আচরণ বদলে যায়। চেয়ারে বসার আগে ও পরের ছবিগুলোর মধ্যে থাকে ব্যাপক দৃশ্যমান পার্থক্য। মানুষ কতটা বদলে যায়, তার নীরব সাক্ষী যেন চেয়ার। সরকারি প্রতিষ্ঠানে বাহারি চেয়ার অনেক কথাই বলে। একেক ধরনের চেয়ারে উপবিষ্টরা একেক ধরনের আচরণ করে থাকে। তাদের মেজাজ-মর্জিও সেই রকম।

প্রসঙ্গক্রমে একটি গল্প বলি। ঢাকা শহরের এক বস্তির বিশাল মাঠে আগুন থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া সম্ভব, সে বিষয়ে বস্তিবাসীর ধারণা দেওয়ার জন্য মহড়ার আয়োজন করা হয়েছে। প্রধান অতিথি একজন প্রতিমন্ত্রী। বিশেষ অতিথি সচিব। বস্তিতে মোটামুটি আয়োজন করা হয়েছে। মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে।

একজন অতিথি এসে আয়োজকদের বলল, চেয়ার জুতসই হয়নি। বদলে দেওয়া হোক। কেমন চেয়ার?—আয়োজকদের প্রশ্ন। জবাব মিলল, বড়সড় চেয়ার দুটো লাগবে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথির জন্য। চোখে পড়ার মতো। দৌড়ে ডেকোরেটরের কাছ থেকে দুটো বড়সড় চেয়ার আনা হলো। রাজা-বাদশাদের সিংহাসনের মতো। বিশাল চেয়ার, যেন কথা বলে। যাদের জন্য এই চেয়ার আনা হলো, তারা যে সাধারণ নয়, সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। অন্যরা বুঝে নিতে পারবে। একজন বস্তিবাসীর কৌতূহল ছিল। সে জানতে চাইল, অতিথিরা প্রথম এমন জায়গায় এসেছে কি না, বস্তির মানুষের মাঝে এমন চেয়ারে বসে কী বলবে তারা? তবে এটা ঠিক, যে চেয়ারেই তারা বসুক না কেন, এমন একটি বস্তিতে কেউ কিন্তু তাদের চিনতে পারেনি। তবে এটুকু বুঝে নিল, চেয়ারে উপবিষ্টরা নামীদামি। আর অতিথিরা নিজেরা যেন সন্তুষ্ট থাকল আলাদা ধরনের বড় চেয়ারে বসে। অথচ মিডিয়ার মাধ্যমে প্রায়ই দেখি, উন্নত 
দেশে বড় বড় লোকদের কথা বলার জন্য চেয়ার লাগে না। আয়োজন কিংবা আনুষ্ঠানিকতা তেমন নেই।

কেন আজ চেয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে লিখছি? কারণ তো আছে। খেয়াল করেছি, চেয়ার কোনো কোনো ব্যক্তির ইতিবাচক গুণাবলিকে বিলুপ্ত করে, গ্রাস করে। কিংবা ইতিবাচক হতে দেয় না, বরং অহংকারী করে। প্রবল অহংবোধে ভাসায়। তারা চেয়ারের মূল্য দিতে শেখেও না, পারেও না। এতে শুধু নিজে নয়, অন্যরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আসুন, চেয়ারকে সমতার উত্তম উপায় হিসেবে বিশ্বাস করি।

লেখক: স্বপ্না রেজা, কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ