হোম > ছাপা সংস্করণ

বাবা-এ-উর্দুর সুকীর্তি-কুকীর্তি

ড. এম আবদুল আলীম

পাকিস্তানের সব অঞ্চলের মানুষকে এক পতাকাতলে সমবেত করতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরপরই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারা দাপ্তরিক কাজে যেমন বাংলা ভাষা বর্জন করতে থাকে, তেমনি জোর করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। তাদের এই কাজকে সমর্থন করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন যেসব বুদ্ধিজীবী, তাঁদের শীর্ষ একজন ছিলেন বাবা-এ-উর্দু নামে পরিচিত মওলানা আবদুল হক। তিনি ছিলেন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক গুরু, উর্দু পণ্ডিত, অনুবাদক, ভাষাতত্ত্ববিদ। জন্ম ১৮৭২ সালের ১৬ নভেম্বর, ভারতের ঘাজিয়াবাদ (মিরাট) জেলার হাপুর।

অল্প বয়স থেকেই ভাষা শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন এবং উর্দু, পারসি, ইংরেজি, আরবি প্রভৃতি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। ১৮৯৪ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনের শুরু সরকারি দপ্তরের অনুবাদক হিসেবে। এরপর প্রাদেশিক সরকারের স্কুল ইন্সপেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একই সঙ্গে তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। হায়দরাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেন। এখানকার পাঠ্যক্রম সব বিভাগে উর্দু পাঠ বাধ্যতামূলক করতে ভূমিকা রাখেন। তিনি উর্দু বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একাডেমিক দিক থেকে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সমপর্যায়ে উন্নীত করেন। তিনি অনেক দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করেন। সেগুলোর মধ্যে ছিল Meraajul Ashqeen (১৯২৪), Zikr-e-Mir (১৯২৮), Bah-o-Bahar (১৯৩১), Bah-o-Bahar (১৯৩২), Nikat-o-Shoara (১৯৩৫), Nusrait (১৯৩৮), Qutub Mushari (১৯৩৯) প্রভৃতি। ১৯৩০ সালে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি English Urdu Dictionary সম্পাদনা করেন। এ ছাড়া তাঁর অন্য উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হলো চাদ হাম আসার, মাক্তবাত, মুকাদ্দিমাত, তাওকিদা, কায়ই-ই-উর্দু, দেবাচা দাসতান রানি কিতকি প্রভৃতি। উপমহাদেশে উর্দু ভাষার চর্চা ও উন্নতির জন্য তিনি ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আঞ্জুমান ই তরিক্কি ই উর্দু’ নামক সংগঠন। উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপক উন্নতি বিধান করায় তাঁকে ‘বাবা-এ-উর্দু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

১৯১২ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত ‘আঞ্জুমান ই তরিক্কি ই উর্দু’র সেক্রেটারি ছিলেন। মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর অনুসারীরা উর্দু হরফ পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রচার চালালে এই সংগঠনের মাধ্যমে তার প্রতিকারে কাজ করেন।

পাকিস্তান আন্দোলনে যেমন অবদান রাখেন, তেমনি এই রাষ্ট্রে উর্দু ভাষার চর্চা প্রসারে কাজ করেন। ১৯৪৮ সালে স্থায়ীভাবে পাকিস্তানে চলে যান। ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে পাকিস্তানে গিয়ে উর্দু ভাষার উন্নয়নে কাজ করেন। উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সরকারি উদ্যোগ তিনি জোরালোভাবে সমর্থন করেন। তিনি ফতোয়া দেন, ‘ইসলামি তমদ্দুনের সহিত সংশ্রবশূন্য সংস্কৃত ভাবধারার বাহন বাংলা কোনোমতেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গণ্য হইতে পারে না। উর্দুর ওপরই পাকিস্তানের দৃঢ়তা ও অখণ্ডতা নির্ভর করে। অন্য কোনো ভাষাকে উর্দুর সমমর্যাদা দান করা পাপ।’

১৯৫২ সালের ২১ মার্চ তিনি উর্দুর পক্ষে এবং বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে করাচিতে এক বিবৃতি দেন। ওই বিবৃতিতে তিনি বলেন: ‘উর্দুর ওপরই পাকিস্তানের সংহতি ও একতা নির্ভর করছে। ভোটের দ্বারা ভাষা সমস্যার সমাধান হবে না। আর ভোটের দ্বারাই যদি এর মীমাংসা করতে হয়, তাহলে পার্লামেন্টে বা তার বাইরে যেখানেই হোক, প্রাদেশিক ভিত্তিতে তা করতে হবে। কারণ, বিষয়টি প্রতিটি প্রদেশেরই স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষার উপযুক্ত। পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে পৃথক ভাষা থাকলেও একমাত্র উর্দুই সর্বত্র বোধগম্য ভাষা। পূর্ববঙ্গে লাখ লাখ লোক উর্দুতে কথা বলেন এবং লেখাপড়া শেখেন, কিন্তু পূর্ব বাংলার বাইরে বাংলার প্রচলন নেই। বাঙালিদের উর্দুর প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা রয়েছে। তাঁরা একে ইসলামি ভাষা বলে বিবেচনা করেন ইত্যাদি।’ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় বাবা-এ-উর্দুর এই বিবৃতির প্রতিবাদ করা হয় এবং তাঁর বক্তব্যের বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে সম্পাদকীয় লেখা হয়।

তিনি ১৯৫২ সালের এপ্রিল মাসে ‘আঞ্জুমানে তরিক্কি ই উর্দু’র পাঞ্জাব শাখার উদ্যোগে লাহোরে উর্দু সম্মেলনের আয়োজন করেন। ওই সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার দাবি জানানো হয়। এ প্রসঙ্গে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় বলা হয়: ‘সাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, আইনজীবী ও এমএলএ প্রভৃতি মিলিয়া লাহোরের প্রায় পাঁচ শ ব্যক্তি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করার জন্য আঞ্জুমানে তরিক্কি ই উর্দুর পাঞ্জাব শাখার উদ্যোগে যে সভা হয়, তাহাতেই এই দাবি (উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার) জানানো হয়। তাঁহারা এক প্রস্তাবে বিশেষ জোরের সহিত আবেদন বলেন যে, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করিয়াই পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করা সম্ভব। এতদ্ব্যতীত উর্দু ভাষার গুরুত্ব ও উহার রাষ্ট্রভাষা হইবার উপযুক্ততা বর্ণনা করিয়াও তাঁহারা কতকগুলি প্রস্তাব গ্রহণ করেন।’

১৯৫৪ সালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তিনি আবারও মাঠে নামেন। এবার নিজেই রাজপথে নেমে মিছিলে নেতৃত্ব দেন। তিনি জোর গলায় বলতে শুরু করেন, উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা না হলে পাকিস্তানের তমদ্দুনিক ঐক্য ও যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনীতির মর্মবস্তু ধ্বংস হয়ে যাবে। ২২ এপ্রিল তাঁর নেতৃত্বে উর্দু-সমর্থকদের একটি বিক্ষোভ-মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। উর্দুর পক্ষে এবং বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত ওই বিক্ষোভে উর্দুকে একমাত্র জাতীয় ভাষা ঘোষণার দাবি তোলা হয়। সকাল থেকে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী এবং নানা শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষ এতে অংশগ্রহণ করেন। বিক্ষোভকারীরা শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করেন এবং সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও যানবাহন বন্ধ করে দেন। আল-ওয়াহিদ নামক একটি সিন্ধি পত্রিকার অফিসে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা চালানো হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন বাবা-ই-উর্দু মৌলভি আবদুল হক। মিছিলটি গণপরিষদ ভবনে যায় এবং একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। প্রধানমন্ত্রী এই মর্মে আশ্বাস দেন যে, পরদিন তিনি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে একটি বৈঠকে বসবেন এবং তাতে মৌলভি আবদুল হককেও যোগদানের আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎকালে মিছিল থেকে একদল বিক্ষুব্ধ কর্মী গণপরিষদ ভবনে ব্যাপক ভাঙচুর চালান। তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিপেটা করে। এ ঘটনায় ওই দিন গণপরিষদের অধিবেশন ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করা হয়।

মৌলভি আবদুল হক বাংলা ভাষার বিরোধিতা করে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়ে থাকলেও ভারত উপমহাদেশে উর্দু ভাষার উন্নয়নে নানাভাবে কাজ করেছেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত তিনি উর্দু পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা; প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উর্দু শিক্ষার বিস্তারে কাজ করেন। উর্দু শিক্ষার বহুমুখী প্রসারের লক্ষ্যে তিনি একটি ‘উর্দু বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। ১৯৫৯ সালে আয়োজন করেন ‘নিখিল পাকিস্তান উর্দু সম্মেলন’। ১৯৬১ সালের ১৬ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৪ সালে পাকিস্তান সরকার তাঁর নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। ‘বাবা-এ-উর্দু’সহ মুসলিম লীগের উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। পূর্ববঙ্গের ছাত্রজনতার আত্মত্যাগ এবং সর্বস্তরের মানুষের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দু ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ