হোম > ছাপা সংস্করণ

চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়...

বিভুরঞ্জন সরকার

১০ মার্চের আজকের পত্রিকার প্রথম পাতায় ‘তাঁর উত্থানে বিস্ময়, পতনে আনন্দ’ শিরোনামের খবরটি পড়তে গিয়ে নকুল চন্দ্র বিশ্বাসের একটি জনপ্রিয় গানের কথা মনে পড়ল। গানটির প্রথম কয়েক লাইন এমন: 
কষ্ট করে দিনে-রাইতে
কত টাকা করছ কামাই
এত টাকা ক্যামনে নিবা
কাফনের তো পকেট নাই। 
হায় বাড়ি-গাড়ি আহামরি
সোনাদানা ভরি-ভরি
টিভি-ফ্রিজ-চেইন-ঘড়ি
নেতাগিরি-বাহাদুরি
উমেদারি-জমিদারি
পড়ে রইব
কিচ্ছা খতম হইব। 

ফরিদপুরের একসময়ের মহাক্ষমতাধর খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরের কিচ্ছা সম্ভবত খতম হওয়ার পথে। তাঁর গল্পটি অন্য আর দশটা উত্থানপর্বের গল্পের মতোই। তেমন কেউকেটা ছিলেন না, আকস্মিকভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ফরিদপুরের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা থাকেন, তাঁদের আনুকূল্য, অনুগ্রহ না পেলে আমাদের দেশে কারও পক্ষে ক্ষমতাধর হয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। বাবর সাহেবও ক্ষমতার আনুকূল্য পেয়ে মাত্র কয়েক বছরেই তড়তড়িয়ে ওপরে উঠেছেন। ভাইয়ের ক্ষমতার দাপটে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তাঁর ভাইয়ের নাম খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনের সাংসদ ও সাবেক মন্ত্রী।

খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরের হঠাৎ উত্থানে বিস্মিত হয়েছিলেন ফরিদপুরের মানুষ। সেই বাবরকে গ্রেপ্তারের পর সাধারণ মানুষ শহরে মিষ্টি খেয়ে মিছিল করেছে, তাঁর হাতকড়া পরা ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছে।

২ হাজার কোটি টাকার মানি লন্ডারিং মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি বাবর রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকার একটি বাসায় আত্মগোপন করেছিলেন। ৭ মার্চ রাতে ফরিদপুর জেলা পুলিশের একটি দল তাঁকে গ্রেপ্তার করে পরের দিন বিকেলে জেলহাজতে পাঠিয়েছে। মোহতেশাম হোসেন বাবরের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো: চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়!

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিশেষ সুবিধাভোগী হলেও বাবর ছিলেন একসময় বিএনপির সাবেক সাংসদ ও মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি আপন ভাই আওয়ামী লীগ প্রার্থী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন না। কিন্তু ওই নির্বাচনে খন্দকার মোশাররফ হোসেন জয়লাভ করে মন্ত্রী হওয়ার পর ধীরে ধীরে তিনি ভাইয়ের ক্ষমতাবলয়ে ঢুকে পড়েন। এমন অভিযোগ ফরিদপুর আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা করেছেন যে খন্দকার মোশাররফ নিজের প্রয়োজনে, অর্থ আত্মসাৎ করার জন্য বাবরকে কাছে টেনে নেন। ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফরিদপুরের আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ বাবরের হাতে চলে যায়, তিনি হয়ে ওঠেন দলের সর্বেসর্বা। মন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ফরিদপুর সদরের বিভিন্ন অফিস-আদালতে প্রভাব বিস্তার করেন। তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় কিছু লোক ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ, পাসপোর্ট অফিস, সড়ক বিভাগ, এলজিইডি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন। এসব টেন্ডার থেকে তিনি কমিশন নেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন-পীড়নের লক্ষ্যে গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী।

উচ্চাভিলাষী বাবরের মনোযোগ ছিল সব সময় অর্থ-বিত্তের দিকে। সুযোগ-সুবিধা লুটতেই তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। মালয়েশিয়ায় একটি বাড়ি রয়েছে তাঁর, যেখানে তাঁর ছেলে থাকেন। ফরিদপুরের কৈজুরী ইউনিয়নের বাইপাস সড়কের পাশে আরেকটি বাড়ি নির্মাণ করেন তিনি। এ ছাড়া বিপুল ভূসম্পত্তির মালিক হন বাবর।

সব উত্থানেরই পতন আছে। বাবরেরও পতন হয়েছে। ফরিদপুরের মানুষ খুশি হয়েছে। তবে এ প্রশ্নও সামনে এসেছে যে বাবর কি দেশে একজন? ফরিদপুর ছাড়া অন্য জেলাগুলোতে কি এক বা একাধিক বাবর নেই? তাদের লাগাম টেনে ধরা হবে কবে?

এর আগে ২০১৯ সালের শেষ দিকে ক্যাসিনো-জুয়া-মদের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় এমন একটি ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান আরও বিস্তৃত হবে এবং গুটিকয়েক ব্যক্তি নয়, দুর্নীতিবাজ রাঘববোয়ালরাও রেহাই পাবেন না। সে সময় ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটসহ যে কয়জন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন সংগঠনের পদাধিকারী। তাঁদের আগের রাজনৈতিক পরিচয় যদি ভিন্নও থাকে, তাহলেও এটাই সত্য যে তাঁরা বর্তমান পরিচয়েই নানা ধরনের অনৈতিক ও অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িত হয়ে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে নগদ যে পরিমাণ টাকা উদ্ধার করা হয়েছিল, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। কোটি কোটি টাকা বাসায় বা অফিসে রেখে তাঁরা একদিকে তাঁদের টাকার গরমের প্রকাশ ঘটিয়েছেন, অন্যদিকে দেশের ব্যাংকিং খাতকে ফোকলা করে দিয়েছেন। তাঁরা বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করেছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ১৯৭৪ সালে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। কারণ, আওয়ামী লীগেরই কেউ কেউ তখন রিলিফ চুরিসহ নানা ধরনের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল। বর্তমান সরকারের আমলে মাদকবিরোধী অভিযানের সময়ও ‘ইয়াবা বদি’ নামে পরিচিতি অর্জনকারী কক্সবাজারের দাপুটে সাবেক সাংসদের গায়ে টোকা দেওয়া সম্ভব হয়নি। দুর্নীতি-অপকর্মের সঙ্গে কিছু নাম প্রতীকের মতো হয়ে যায়। এই প্রতীকগুলো ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে অন্যদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিলে সেটা মানুষের কাছে তেমন প্রশংসা পায় না। মানুষ দেখতে চায় সবচেয়ে আলোচিত খারাপ মানুষটি রেহাই পায় কি না! সবচেয়ে খারাপকে রেহাই দিয়ে মধ্য এবং নিম্নস্তরের অসংখ্যজনকে শাস্তির আওতায় আনলেও মানুষ খুশি হয় না। যেকোনো অভিযানের সফলতা নির্ভর করে জনতুষ্টির ওপর।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় বলেছিলেন, ‘আমাদের দলের কে, কী, সেটা আমি দেখতে চাই না। আমার আত্মীয়-পরিজন আমি দেখতে চাই না। কে কত বেশি উচ্চবিত্ত, সেটা আমি দেখতে চাই না। অনিয়ম যেখানে আছে, দুর্নীতি যেখানে আছে বা আমাদের দেশকে ফাঁকি দিয়ে যারা কিছু করতে চাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতি মানুষ আস্থা রাখতে চায় এই কারণে যে তিনি কথার খেলাপ করেন না। তিনি তাঁর অবস্থান থেকে সরে যান না। কৌশলগত কারণে সাময়িক কিছু নমনীয়তা দেখালেও শেষ পর্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে হলেও তিনি তাঁর অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। তাঁর রাজনীতির লক্ষ্য পিতার অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা। তিনি নিজে কিছু পাওয়ার জন্য নয়, দেশ এবং দেশের মানুষকে কিছু দেওয়ার জন্য রাজনীতি করেন। তিনি মৃত্যুকে বারবার কাছে থেকে দেখেছেন। তাই তিনি অকুতোভয়ে সামনে এগিয়ে যেতে দৃঢ়সংকল্প।

বঙ্গবন্ধু জানতেন, কারা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে বা করছে। কিন্তু তাঁর হৃদয় ছিল বিশাল, পিতার সহৃদয়তা নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কঠোরতা না দেখিয়ে সংশোধনের সুযোগ দিয়েছিলেন। চোরা যে ধর্মের কাহিনি শোনে না–এটাও বঙ্গবন্ধু জানতেন। তারপরও হয়তো বিশ্বাস করেছিলেন, যে বাঙালির জন্য তিনি স্বাধীন দেশ অর্জনে নেতৃত্ব দিলেন, সেই বাঙালি আর যা-ই হোক, পিতৃঘাতী হবে না। কিন্তু কিছু কুলাঙ্গার বাঙালি বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। শেখ হাসিনা এই বেদনাময় ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। তিনি তাঁর আশপাশে যাঁরা আছেন, তাঁদের চেনেন, জানেন। তাঁদের ঠিকুজি তাঁর হাতে থাকার কথা। তাই তিনি ঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করেন। কারও অন্যায়, অন্যায্য দাবি বা আবদার তিনি রক্ষা করেন না। সেটা হোক দেশের ভেতরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিংবা দেশের বাইরের কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা রাষ্ট্র।

কিছু সময়ের জন্য লাগাম ছেড়ে দিলেও তিনি জানেন কখন আবার লাগাম টানতে হয়। তিনি আওয়ামী লীগ নামক দলটিকে পুনর্জীবন দিয়েছেন। এই দলের সবলতা-দুর্বলতাও তাঁর নখদর্পণে। বিপদে কারা সঙ্গে থাকে, কারা পালায়—সেটাও তাঁর অজানা নয়। তিনি নানা সময়ে তাঁর বিচক্ষণতা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন।

দেশ একদিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে সীমাহীন ধনবৈষম্য সামাজিক স্থিতি বিনষ্টের উপাদান তৈরি করছে। বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রীর অজ্ঞাত নয়। তিনি এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া লোকজনের কারণে সামাজিক বৈষম্য বাড়ে এবং সৎভাবে যাঁরা আয়-উপার্জন করেন, তাঁদের সন্তানেরা হতাশায় ভোগে। শিশুরা তো বুঝতে পারে না, তাই তারা মা-বাবার কাছে জানতে চায়, ওরা যদি দামি গাড়িতে স্কুলে আসা-যাওয়া করতে পারে, আমরা কেন পারি না? এমন পরিস্থিতিতে একটি সমাজ এগোতে পারে না। এমন পরিস্থিতির অবসানের জন্যই সমাজের বৈষম্যের এ জায়গাটিতে আঘাত দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। এটা করা হচ্ছে সামগ্রিক স্বার্থে।’

বিভিন্ন ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে যে দেশে কিছু মানুষের হাতে অনেক টাকা জমা হয়েছে। আবার অনেক মানুষের হাতে কোনো টাকাই নেই। টাকা নেই মানে তাদের সঞ্চয় নেই—না ব্যাংকে, না সিন্দুক বা ট্রাংকে। তারা কোনোরকমে বেঁচে আছে। আর অসহায়ভাবে দেখছে স্বল্পসংখ্যক মানুষের উৎকট ধনস্ফীতি। 
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাই বলেছিলেন, ‘অসৎ উপায়ে অর্জিত অর্থের বাহাদুরি, সে সম্পদের শো-অফ করা, আর যারা সৎপথে চলবে, তারা একেবারে মরে থাকবে—এটা তো হতে পারে না।...দেশের প্রত্যেক মানুষ উন্নত ও সুন্দর জীবনযাপন করবে। এই সুযোগে কিছুসংখ্যক মানুষ সমাজকে বিষাক্ত করবে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণে এই নির্দেশ (দুর্নীতিবিরোধী অভিযান) দিয়েছি।’

সমাজ থেকে বিষবৃক্ষ উৎপাটনের অভিযান বন্ধ হলে মানুষের অস্বস্তি বাড়ে, উদ্দেশ্যের সততা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। দুর্নীতিবাজদের অবস্থা ও অবস্থান বিবেচনা না করে মন্ত্রী, এমপি, দলের অন্য প্রভাবশালী নেতা এবং প্রশাসন ও শৃঙ্খলা বাহিনীর যাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত বলে জনশ্রুতি রয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ