প্রতিনিয়ত সমাজের নানা ধরনের নেতিবাচক সংবাদে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। খুন-খারাবি, হত্যা, মানব পাচার, শিশু ও নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ডে মানুষের মৃত্যু, দুর্নীতিসহ নানা ঘটনায় মানুষের মন যখন বিষিয়ে উঠছে, সেই সময়ে যশোর শহরের কিছু তরুণের প্রচেষ্টায় নিরন্ন মানুষের জন্য একবেলা খাওয়ার আয়োজন করার খবর ক্ষণিকের জন্য হলেও আমাদের মনে ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি করে। আজকের পত্রিকায় রোববার ‘ক্ষুধার্তের মুখে হাসি ফোটায় ব্যাক বেঞ্চার মেজবান’ শিরোনামের খবর অনেককেই আনন্দিত করতে পারে।
দরিদ্র মানুষের জন্য বিনা মূল্যে প্রতি মাসের প্রথম শুক্রবার দুপুরে এমন খাবারের আয়োজন করে থাকে যশোরের এসএসসি ১৯৯৯ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘ব্যাক বেঞ্চার’। ‘খাবার আছে যতক্ষণ, পরিবেশন করা হবে ততক্ষণ’ স্লোগান নিয়ে ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রথম দিকে ৬০ থেকে ৭০ জন মানুষ খেতে এলেও এখন চার শ মানুষ আসছে। এই আয়োজনে মূলত সমাজের সুবিধাবঞ্চিত তথা বস্তিবাসী, ভিক্ষুক, শ্রমজীবী, রিকশাচালকসহ নানা পেশার মানুষজন একবেলা ভালোভাবে খেতে পারেন।
যশোরের এই তরুণদের প্রচেষ্টা একটা উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস। কারণ অপরের দুঃখ-কষ্ট নিজের জীবনের অংশ মনে করতেই তাঁরা এ উদ্যোগ নিয়েছেন। সমাজজীবনে অনেকের অনেক অপূর্ণতা নিয়েই নানা অভিযোগ-ক্ষোভ থাকে। সেই অপূর্ণতা ও দুঃখ-কষ্টকে হৃদয়ঙ্গম করে আর দশজনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলে কিছুটা হলেও মুক্তি পাওয়া সম্ভব—এই বোধ যত বেশি করে সমাজের মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হবে, তত বেশি মানবিকতা বোধ বৃদ্ধি পাবে।
ছোটবেলায় শিক্ষকেরা প্রায়ই শিখিয়ে থাকেন, মানুষের জীবন সার্থকতা পায় মনুষ্যত্ব অর্জন করে। শুধু বই পড়লেই জ্ঞান অর্জন হয় না। অর্জিত শিক্ষাকে সাধনার মাধ্যমে বিবেক, বুদ্ধি ও মনন শক্তি জাগ্রত করে মানুষ হয়ে ওঠে প্রকৃত মানুষ। কিন্তু আমরা সেই প্রকৃত মানুষ হওয়ার দীক্ষা থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছি।
ভোগবাদী জীবনযাপনে আমরা এতটাই নিজেদের জড়িয়ে রাখছি যে পাশের বাড়ির লোকজনের খবর নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না। ফলে হিংসা, নিন্দা, প্রতিহিংসা, শত্রুতা, হানাহানি, হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি বর্তমান সমাজকে গ্রাস করে ফেলছে। সম্পদ আহরণ ও ভোগের দুরন্ত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা।
এ রকম এক অসহায় পরিবেশে যদি নিরন্ন মানুষের পাশে এসে কেউ দাঁড়ায়, তাহলে বুঝতে হবে, এখনো আশা আছে। এখনো সবকিছু নষ্টদের অধিকারে চলে যায়নি।
দিন যত যাচ্ছে, গরিব আর বড়লোকের মধ্যে ব্যবধান তত বাড়ছে। অথচ এই পৃথিবীটা আরেকটু অন্য রকম হতে পারত। কমতে পারত মানুষে মানুষে দূরত্ব।
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথাতেই খুঁজে নেওয়া যায় দিশা, ‘তুমি মাটির দিকে তাকাও, সে প্রতীক্ষা করছে,/ তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায়।’ এ কথাগুলোকে পাথেয় ভাবলে সমাজের নিঃস্ব মানুষদের বোঝা একটু হলেও সহজ হবে।