হোম > ছাপা সংস্করণ

অর্জনের আন্তর্জাতিক উদ্ভাসেও বাদ সাধে ওরা

অজয় দাশগুপ্ত

অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশিদের অভিবাসনের বয়স খুব দীর্ঘ কিছু না। বিলেত বা ইউরোপে আমাদের যাতায়াত ও অভিবাসনের বয়সের কাছে এই ইতিহাস শিশু। আমেরিকা, কানাডার পর বাংলাদেশিরা ক্যাঙারুর দেশে পা রাখতে শুরু করে। ব্যক্তিগতভাবে আমি যখন অভিবাসন নিয়ে আসি, তখন হাতেগোনা বাঙালি পরিবার ছিল সিডনিতে। সাকল্যে হাজার কয়েক। তা-ও আবার নানা দলে-উপদলে বিভক্ত। সত্যি বলতে কি, আমি যখন আসি এবং যাঁদের সঙ্গে ছিলাম, তাঁদের সবাই যুক্ত ছিলেন এখানকার পূজা কমিটিতে; অর্থাৎ হিন্দুঘেঁষা, হিন্দুনির্ভর। অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনীতি ও ঐতিহ্য নিয়েও কাজ করছিল অনেক সংগঠন। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু পরিষদ এবং তাদের বৈশাখী মেলা ছিল মেলামেশা ও যোগযোগের কেন্দ্রবিন্দু। ছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি। আর আমরা চাই বা না চাই ঘরে ঘরে জামায়াতের প্রভাবও স্পষ্ট। যে কয়জন প্রয়াত অগ্রজ বাংলাদেশিদের এক করার জন্য, তাঁদের সুখ-দুঃখে পাশে থাকার জন্য চেষ্টা করতেন, তাঁদের মধ্যে প্রয়াত নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. আবদুর রাজ্জাক ও রুহুল হক উজ্জ্বলের কথা মনে পড়ছে। জীবিত অগ্রজ গামা আবদুল কাদিরসহ আরও অনেকেই আছেন এই তালিকায়। তবে এখনকার মতো জমজমাট আর লোকারণ্য বাঙালি পরিবেশ ছিল না। আমরা মাছ খেতে হলে ভিয়েতনামি দোকানে ছুটতাম। যেখানে ভুল বাংলা বানানে লেখা থাকত ‘বাংলাদেশের ইলিশ পাওয়া যায়’। আর এখন? কোন দোকান থেকে আসল ইলিশ কিনবেন, সেটাই হচ্ছে সমস্যা। প্রায় লাখখানেকের কাছাকাছি বাংলাদেশি অস্ট্রেলিয়ার নানা শহরে বসবাস করেন। তাঁদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় বাঙালিদের তফাত এক জায়গায়। যেখানেই আমরা, সেখানেই অনুষ্ঠান, আতিথেয়তা এবং দেশজ বিষয় উদ্‌যাপন। হয়তো তাঁরাও করেন, কিন্তু একেবারে নিজেদের ভেতর। আর আমাদের যেকোনো আয়োজন হচ্ছে বিশাল এবং আন্তরিকতা ও দলীয় বা অন্তঃকোন্দলমুখর।

বাঙালি ভাষাপাগল এক জাতি। আমি খেয়াল করেছি সব জাতিরই মাতৃভাষার প্রতি টান আছে বটে, আমাদের টান বা যোগাযোগ একটু ভিন্ন ধরনের। হতে পারে আমাদের আবেগ, হতে পারে আমাদের প্রকৃতি বা ইতিহাস, এটাই সত্য। বাঙালির এই ভাষাভিত্তিক আবেগ আর শহীদ দিবসের কারণেই আওয়ামী লীগ-বিএনপির কাইজা বা দল-উপদলের বাইরে এক বিপুল ঐক্য গড়ে উঠেছে। সিডনিতে মাটিতে চাদর বিছিয়ে যে বইমেলার শুরু, এখন তা এক মহিরুহ। হাজার হাজার ডলারের বই বিক্রি হয় সেখানে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল থেকে আধুনিক কালের মহিউদ্দিন আহমদ কিংবা নবীন জনপ্রিয় লেখক সাদাত হোসাইন কিংবা জান্নাতুল নাইম প্রীতি—সবার বই থাকে মেলায় এবং তা কিনে বাড়ি ফিরে যাই আমরা। স্বাভাবিক কারণেই ভাষার আবেগ আর শ্রদ্ধায় গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধ। কেন সেটি শহীদ মিনার না? সে কথা অন্য সময়ে লেখা যাবে।

এই স্মৃতিসৌধের আদল আর স্থাপনা বলে দেয়, আমরা একটি ভাষাভিত্তিক জাতিগোষ্ঠী। একুশের শহীদদের মতো প্রভাবশালী আত্মা দুনিয়ায় বিরল। নিশ্চয়ই মনে করবেন বহু বছর পর যাঁরা উদ্যোগ নিয়ে মাতৃভাষা দিবসটিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি দিতে অবদান রেখেছেন, তাঁদের নামও রফিক-সালাম। ইতিহাস বলছে: ‘বাংলাদেশে না হলেও বাঙালির হাত ধরেই এই অসামান্য অর্জনের পথে যাত্রা শুরু হয়েছিল। ২৯ মার্চ কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য সোসাইটি জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব তুলে ধরেন। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম দেশ থেকে অনেক দূরে থেকেও বাঙালির আত্মত্যাগকে স্বীকৃতি দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেই প্রস্তাবনায় স্বাক্ষর করেছিলেন ভিন্ন ভাষাভাষী ১০ জন সদস্য। তবে জাতিসংঘের পরামর্শ অনুযায়ী বিষয়টি নিয়ে প্যারিসে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংগঠন ইউনেসকোতে যোগাযোগ করা হয়। এরপর পেরিয়ে যায় এক বছর। কোনো সিদ্ধান্ত না এলেও কানাডাপ্রবাসী আরেক বাঙালি আবদুস সালামকে নিয়ে ইউনেসকোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন তিনি।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর একুশে ফেব্রুয়ারি পায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিশেষ সেই মর্যাদা। ইউনেসকোর সেই অধিবেশনে এই দিবস পালনের মূল প্রস্তাবক ছিল বাংলাদেশ ও সৌদি আরব। তবে সমর্থন ছিল পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেরই।

এভাবে দিনটি মর্যাদা আর গৌরবে সিক্ত হয়ে ওঠে প্রবাসী বাংলাদেশিদের আন্তরিক প্রচেষ্টায়। সে থেকে দেশে দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধ নির্মাণের ব্যাপারটিও প্রিয়তা পায়। সিডনির এশফিল্ডে মূল স্মৃতিসৌধটি থাকার পাশাপাশি বাঙালিপাড়া নামে খ্যাত লেকেম্বা বেলমোর এলাকায়ও তারুণ্য ঝাঁপিয়ে পড়ে আর একটি শহীদ মিনার কিংবা স্মৃতিসৌধ নির্মাণে। যথারীতি নানা অভ্যন্তরীণ ঝুটঝামেলা আর সংকট থাকে। সেসব পাশ কাটিয়ে ২০২১ সালে গড়ে ওঠে আরেকটি স্মৃতিসৌধ। এ স্মৃতিসৌধটি উন্মোচন করেছিলেন ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় এমপি। স্থানীয় মেয়রসহ গণ্যমান্য অজি তারকাদের সবাই ছিলেন। এখন এক বছর পর ভাষার মাসের প্রথম দিনে এই স্মৃতিস্তম্ভের ওপর আঘাত হেনেছে একদল বাংলা-বাংলাদেশবিরোধী মানুষ। কে বা কারা এ কাজ করেছে, তা নিশ্চয়ই সময়ের গতিতে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই:

এক. এটা যদি অন্য কারও অনুভূতিতে আঘাত আনত, তো তারা এক বছর চুপ ছিল কেন?

দুই. আমাদের উপমহাদেশের দুই অবিচ্ছেদ্য অতীতের ভারত আর পাকিস্তান ছাড়া বাকিরা না জানে এর মর্ম, না ইতিহাস।

তিন. ঘরের শত্রু বিভীষণেরা ছাড়া এ কাজ হতে পারে?

চার. যে দেশে, যে সমাজে, রাস্তাঘাটে, গলিতে-গলিতে নগ্ন, অর্ধনগ্ন নারীদের ভাস্কর্য, পুরুষদের তেমন সব মূর্তি, সেখানে এমন একটা নীরোহ স্মৃতিসৌধের গায়ে কেন আঁচড় পড়ল?

পাঁচ. তারা কীভাবে জানল যে ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস আর তার প্রথম দিনেই বা রাতে এর গায়ে দাগ কাটতে হবে?

এই ঘটনার ভেতর দিয়ে আমি যা দেখলাম, স্মৃতিসৌধটির শরীরে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার লাল-সবুজ আর নিচের দিকে আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের আঁকিবুঁকির ওপর যত রাগ আর ঝাল। অথচ মূর্খদের ধারণাই নেই আমরা এমন এক জাতি, যারা আদিবাসী বা অ্যাবরোজিনাল নামে পরিচিত অজিদের ভাষা হারানোর বেদনা জানি। তাদের মুখের ভাষা আজ বিলুপ্ত। ঋদ্ধ বলিষ্ঠ আর সংস্কৃতিসম্পন্ন ভাষা হারিয়ে গেছে সমূলে। গাঁক-গাঁক করে ইংরেজি বললেও আসলে লুণ্ঠিত হয়েছে তাদের ভাষা। সে জায়গায় এই স্মৃতিসৌধ ভাষার শক্তি আর ভালোবাসার প্রতীক। বাঙালির এই অর্জন বা বিস্তার যাদের ভালো লাগে না, তারা কারা? তাদের আমরা সবাই চিনি।

এই লেখাটির সঙ্গে রাজনীতি না জড়ালেই ভালো হতো। কিন্তু বলতেই হবে, লবিস্ট আর বিদেশে কুৎসা রটানো বাংলাদেশি নামে পরিচিতজনেরা কোথাও থেমে নেই। তাদের কালো থাবা কত ভয়ংকর, সিডনি তারই একটা প্রমাণ দেখল। ভাষার মাসে দেশে-বিদেশে বাঙালির ভাষা স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার এবং অর্জন মজবুত রাখা আর তার নিরাপত্তার দায় সবার। এটা যেন ভুলে না যাই আমরা।

অজয় দাশগুপ্ত: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ