হোম > ছাপা সংস্করণ

লাল সংকেতে জলবায়ু

আলম শাইন

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে ২০১৬ সালে অ্যান্টার্কটিকার ৯৬৫ বর্গকিলোমিটারের হিমবাহের চাঁইয়ে চিড় ধরতে দেখেছেন গবেষকেরা। ২০২০ সালের এক রিপোর্টে জানা যায়, এক বছরে প্রায় ৫৩২ বিলিয়ন টন বরফ গলেছে গ্রিনল্যান্ড থেকে। ২০১৯ সালে গ্রিনল্যান্ডে তিন কিলোমিটারের বরফের চাঁই ভেঙে পড়েছে। তাতে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪০ শতাংশ পানি বেড়েছিল। বরফের চাঁই গলতে শুরু করায় সেখানকার পরিস্থিতি ভয়াবহতার দিকে মোড় নিয়েছে। সমুদ্রে প্রতি সেকেন্ডে ৬টি অলিম্পিক সুইমিংপুলের সমপরিমাণ জল পড়ছে। তাতে দেখা গেছে, প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ টন পানির পরিমাণ বাড়ছে। গ্রিনল্যান্ডের বরফের চাঁই গলার পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করে ব্রিটেনের ‘ইউনিভার্সিটি অব লিনকন’ এক গবেষণায় জানিয়েছে, ‘গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলার কারণেই ২১০০ সাল নাগাদ বিশ্বের সমুদ্রস্তরের উচ্চতা ১০-১২ সেন্টিমিটার বাড়বে।’

অপরদিকে নেচার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা গেছে, আর্কটিক মহাসাগরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেড়েছে, যা বরফ যুগেও দেখা গিয়েছিল। উল্লেখ্য, সমুদ্র জলের তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বাড়তে থাকে। গত ৪০-১০০ বছরের মধ্যে দেখা গেছে, গ্রিনল্যান্ডের তাপমাত্রা ১০-১২ ডিগ্রি বেড়েছে। আরেকটি দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতেই উত্তর মেরুর পূর্বাঞ্চলের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে, সেখানকার তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে রয়েছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে যে হারে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে, তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যাবে। আর সেটি হলেই পৃথিবী মহাদুর্যোগের মুখোমুখি পড়বে।

জর্জিয়া ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এভাবে বরফ গলা অব্যাহত থাকলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে দ্রুত। ফলে বিশ্বের নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হবে ব্যাপকভাবে। সেই তালিকার মধ্যে রয়েছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের নামও।

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং শৈত্যপ্রবাহের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই কোনো না কোনো ধরনের দুর্যোগ সংঘটিত হচ্ছে। সেটি হতে পারে তাপমাত্রা বাড়া, খরা, বন্যা, সাইক্লোন, টর্নেডো, ভূমিকম্প, নদীভাঙনসহ নানান দুর্যোগ। তার মধ্যে তাপমাত্রা বাড়াই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে পৃথিবীকে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, লবণাক্ততার কারণে। যার প্রমাণ আমরা বার কয়েক পেয়েছিও। সিডর, আইলা, বুলবুল, আম্পান ও ইয়াসের তাণ্ডবলীলায় মারাত্মক দুর্যোগের শিকার হয়েছিল বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গে ইয়াস ভয়ংকরভাবে আঘাত হানলেও সামান্য দিক পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ সেই যাত্রায় কিছুটা রক্ষা পেয়েছিল। তথাপিও উপকূলীয় অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাসের কারণে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির খবর আমরা জানতে পেরেছি। এসব প্রাকৃতিক তাণ্ডব ঘটছে শুধু বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলেই; যার মূল কারণই হচ্ছে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য বিজ্ঞানীরা মানুষকেই দায়ী করেছেন। যার জন্যই মূলত বৈশ্বিক উষ্ণায়ন অব্যাহত রয়েছে আর পরিবর্তন ঘটছে জলবায়ুর; যা আমাদের কাছে জলবায়ুর সংকট হিসেবে পরিচিত।

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে ধারণা থাকা সত্ত্বেও উন্নত দেশগুলো গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। শুধু কাগজ-কলমের মধ্যেই তাদের উদ্যোগ সীমাবদ্ধ রয়েছে। উন্নত দেশের কর্মকাণ্ডে সমগ্র পৃথিবী আজ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। জানা যায়, বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব প্রান্তসীমা ৩৫০ পিপিএম ছাড়িয়ে অত্যন্ত বিপজ্জনক ৩৯৮ দশমিক ৫৮ পিপিএম ঘনমাত্রায় পৌঁছে গেছে, যা পৃথিবীর অস্তিত্বের প্রতি মারাত্মক হুমকিই বলা যায়।

জাতিসংঘ কর্তৃক জলবায়ুবিষয়ক এবং বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বন্ধে ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিওডি জেনিরোতে কনভেনশনের আয়োজন করা হয়। সেখানে গঠিত হয় ‘জলবায়ুবিষয়ক জাতিসংঘ কনভেনশন’ (ইউএনএফসিসিসি)। ওই কনভেনশনে ১৫০ দেশকে এই নতুন বিধান মেনে চলতে রাজি করানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ প্রশমনে বাধ্যতামূলক করতে প্রটোকল ঘোষণা করা হয়। মূলত ওই সময় থেকেই সদস্যদেশগুলো প্রতিবছর মিলিত হওয়ার জন্য সম্মত হয় এবং প্রতিবছর মিলিত হচ্ছেও। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হচ্ছে না। গাছের গোড়া কেটে পানি ঢালার মতো দরিদ্র দেশকে কিছু অনুদানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে শুধু। অথচ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমেই বাড়ছে। ফলে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশের কারণে মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে হচ্ছে। জানা গেছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ইতিমধ্যেই লবণাক্ততা বেড়ে মানুষের জীবন ও জীবিকায় মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলেছে। যার কারণে বাধ্য হয়ে বাস্তুহারা হতে হচ্ছে বিশাল জনগোষ্ঠীকে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইতিমধ্যে প্রায় ৬০ লাখ বাংলাদেশি বাস্তুহারা হয়েছে, আর তাদের অধিকাংশই এখন শহরমুখী।

পরিবেশবিজ্ঞানীদের অভিমত, আর মাত্র ৪৫ সেন্টিমিটার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লেই উপকূলীয় অঞ্চলের ১০ শতাংশ ভূমি তলিয়ে যাবে। তবে এই অভিমত অপ্রতিষ্ঠিত হিসেবে ধরে নিচ্ছে অন্য গবেষক দল। কারণ, ইতিমধ্যে জানা গেছে, ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে এমন জায়গাগুলোতে ভারসাম্য বজায় থাকবে সমুদ্রে উচ্চমাত্রার পলির আগমনে। তার কিছুটা প্রমাণও মিলেছে। যেমন হাতিয়া অঞ্চলসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিশাল আয়তনের চর জেগেছেও।

অন্যদিকে ২০০৫ সালে ‘আইপিসিসি’ জানিয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ২১ শতাংশ লবণাক্ত জলে সয়লাব হয়ে যাবে। নানা ধরনের তর্ক-বিতর্কের ফলে সর্বশেষ যা আমরা অবগত হয়েছি তা হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ মহাদুর্যোগের মুখোমুখি হবে, যা অবধারিত সত্য কথা। আর এই মহাদুর্যোগের জন্য দায়ী হচ্ছে শুধু শিল্পোন্নত দেশের খামখেয়ালিপনা। শিল্পোন্নত দেশগুলো গ্রিনহাউস গ্যাস অধিকহারে নিঃসরণ করে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়িয়ে হিমবাহর চাঁই গলতে ত্বরান্বিত করছে। ফলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার আরও কিছু দেশ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ। সেই বিপর্যয় থেকে আদৌ উত্তরণ মিলবে কি না, তাতে সন্দিহান আমরা। যদি বিশ্ববিবেক জাগ্রত হয়, তবে আমরা এই মহাদুর্যোগ থেকে উত্তরণ পাব হয়তো। তাই বিশ্ববিবেকের কাছে আমাদের আরজি, সময় থাকতে দ্রুত পদক্ষেপ নিক; কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে জলবায়ুযুদ্ধে বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে বিজয়ী করতে সাহায্য করুক।

উল্লেখ্য, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জাতিসংঘের একটি সংস্থা ‘ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (আইপিসিসি) ৪২ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। সেই প্রতিবেদনটিকে জাতিসংঘের মহাসচিব (৯ আগস্ট, ২০২১) ‘মানবজাতির জন্য লাল সংকেত’ হিসেবে অভিহিত করেন। জলবায়ু ও পরিবেশ বিষয়ে জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করলেও বিশ্ব মোড়লেরা ততটা সরব নয়; তা আমরা উপলব্ধি করছিও। তারপরেও আমাদের বিশ্বাস, জলবায়ু সংকটের লাল সংকেত পেয়ে এবার তাঁরা সরব হবেন।

আলম শাইন, পরিবেশ ও বন্য প্রাণীবিষয়ক কলামিস্ট

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ