যাঁদের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তাঁরা দূরে গেলেও মনে হয় যেন স্পর্শ করেই আছেন। আর কোথাও না হোক, অজ্ঞাতবাসে দেখা মিলবেই। এই আনন্দলোকে কোনো ভাঙন নেই, বিচ্ছেদ নেই, কোনো অবহেলা নেই, কোনো অবজ্ঞা নেই। শুধু প্রেম আর প্রেম।
কিছু কিছু সম্পর্ক রোজ নিয়ম করে দরজা খোলা আর বন্ধ করার মতো। রোজ সকালে খোলা আর সন্ধ্যাবেলা বন্ধ করার মতো নৈমিত্তিক। ‘শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা’।
ইদানীং বই-পুস্তক, ম্যাগাজিন পড়ে আমাদের শিখতে হচ্ছে, ‘সম্পর্কের যত্ন করতে হয়’। আমরা শিখছি ‘কোয়ালিটি টাইম’ বলে একটা ব্যাপার আছে। উল্টো করে বললে, বই-পুস্তক, ম্যাগাজিন পড়ে বা ইউটিউব দেখে রপ্ত করে তো মানুষ মানুষকে ভালোবাসে না। বাসে নিজ থেকে, হৃদয়ে নিজের অলক্ষ্য়েই কখনো সে ভালোবাসার কুঁড়ি ফোটে। তাহলে সম্পর্কের যত্ন করা শিখতে এত কিছু ঘাঁটতে হচ্ছে কেন?
অবশ্য পাশের মানুষটির যত্ন করা যাঁরা ছেড়ে দেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এসব ঘেঁটে শিখতে যান না। দেখা যায়, যাঁর প্রতি যত্ন হারিয়ে যায়, সেই ব্যক্তি নিতান্ত বেকায়দায় পড়ে একটু একটু করে শেখানোর চেষ্টা করতে থাকেন। কারণ, একই পরিবারে থাকা আর পারিবারিক বন্ধন দুটো তো আলাদা। উপেক্ষিত মানুষটির প্রবল একটা আশা কাজ করে, যদি প্রেমময় করে তোলা যায় সম্পর্কটিকে আরেকবার! একটু খেয়াল করে দেখুন, ঘরে যে জায়গাটিতে সবচেয়ে বেশি ধুলো-ময়লা জমেছে; সে জায়গাটিকে আপনি সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেন বলেই সেখানে ধুলো জমেছে; এরপর ধূলি পোকা ও মাকড়সার আনাগোনা শুরু হয় সেখানে। কারণ আপনার নজর ও মনোযোগ সেখানেই সবচেয়ে কম। সম্পর্কের বেলাতেও বোধ হয় এমন; আমরা যাঁকে ভালোবাসি, গুরুত্ব দিই তাঁকে অনুভব না করে কি পারি? কিন্তু পাশাপাশি থাকার পরও যখন তাঁর মধ্যকার আঁধার-আলো আমাদের চোখে পড়ে না, তার মানে হয়তো সে-সম্পর্কে ধুলো জমে গেছে। এরপর আসবে ধূলি পোকা, শুরু করে মাকড়সার আনাগোনা। তবু চোখের জল মুছে অনেকে বোঝা আর বোঝানোয় ক্ষান্ত দেন। শুভাকাঙ্ক্ষীরা বলতে থাকেন, ‘গুরুত্ব দিচ্ছে না? তুমিও কাজে-কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ো, এসব মাথায় আসবে না।’ মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাও একপ্রকার তা-ই বলেন, ‘আমরা নিজেকে বদলাতে পারি, অন্যকে নয়।’ এদিকে নিজের মনে প্রশ্ন জমতে থাকে, পাশের মানুষটির কাছে ‘আমি কাঙ্ক্ষিত, নাকি অনাকাঙ্ক্ষিত’? উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি দুটোর অর্থই কি এক হয়ে যাচ্ছে?
এমনও তো হতে পারে, উপেক্ষিত মানুষটিও উপেক্ষা যিনি করছেন তাঁর চেয়ে কম ব্যস্ত নন। ব্যস্ততার সঙ্গে সম্পর্কের চাহিদার তো কোনো সম্পর্ক নেই। আগে তো বলা হতো পাঁচ বছর; মানে বিয়ের পর পাঁচ বছর ‘তুমি’ দারুণ সুখী। এরপর সম্পর্ক অভ্যস্ততায় পরিণত হয়। ভালোবাসা ট্রাংকে তালাবদ্ধ হয়ে আলমারির ওপরে অবস্থান করে। তবে ইদানীং বোধ হয় বৈবাহিক সম্পর্কে সুবাতাস বয় পাঁচ বছরের কম সময় পর্যন্ত। এসব চিন্তা নেহাত এড়িয়ে গিয়ে সেই মানুষের পাশের বালিশে হয়তো আপনি ঘুমিয়ে পড়েন। যাঁর প্রাণের ভাষা আপনার অজানা। অদূর ভবিষ্যৎ ধোঁয়াশা লাগলেও আশা ছেড়ে, আশা রেখে দিয়েই দিন পার হয়।
দুই.
এই তো কদিন আগে বুয়ার কলবেলে ঘুম ভাঙল। ঢুকতে ঢুকতে বুয়া বললেন, ‘এত দেরিতে উঠলেন, অফিস নাই?’ বললাম, ‘কয়টা বাজে?’ বললেন, ‘সাড়ে নয়টা।’ কী অবাক কাণ্ড; সাড়ে নয়টা বেজে গেছে! জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি এত দেরিতে কেন আজ?’ ঘর ঝাড়ু দিতে দিতে বুয়া বললেন, কাল সারা রাত তাঁর স্বামী বাড়ি ফেরেনি। সকালে ফিরেছে। কোথায় নাকি কাজ হয়েছে, নাইট ডিউটি ছিল। প্রায়ই নাকি এমন নানান অজুহাতে রাতে বাড়ি ফেরেন না তাঁর স্বামী। কাঁদো কাঁদো চোখ-মুখ নিয়ে বললেন, ‘আমাকে যা বুঝায়, তাই বুঝি তো এ জন্য এই অবস্থা। জানি না লোকটা আসলে কী করছে।’ বাড়ির দারোয়ানের কাছে খোঁজ নিয়ে জানলাম, বুয়ার স্বামীর একটা চায়ের দোকান ছিল আমাদের বাসার পাশেই, সেটাও ঠিকঠাক করত না। একপর্যায়ে ছেড়েই দিল। নিতান্ত অলস পুরুষ, এমন একটা ধারণা পেলাম। প্রায়ই নাকি তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আর বুয়া বিচলিত থাকেন। সেদিক থেকে বুয়া বিভিন্ন বাসায় কাজ করে আর জামাকাপড় সেলাই করে আয় করেন। দুটো ছেলেমেয়েকেও পড়াচ্ছেন। এই যে একটা বৈবাহিক সম্পর্ক; ভালো করে ভেবে দেখতে গেলে দেখা যায়, এই সম্পর্কে থাকার কিছু নেই। কারণ কাবিননামায় তো লেখা থাকে না ধৈর্য মেয়েটাকেই ধরতে হবে, রোজগার করতে ও সংসার সামলাতে হবে মেয়েটাকেই। অথবা স্বামী বলে বিনা নোটিশে ঘরে না ফিরলেও চলে। সম্পর্কে থেকে কেউ যদি দিনের পর দিন বিশ্বাসঘাতকতাই করে বা প্রতারণাই করে, তাহলে সে সম্পর্কে কেনই বা স্বামী-স্ত্রী থাকে; সেটাও বোধ হয় অজানা। অভ্যস্ততার কাছে কি মানুষ তাহলে এতটাই বাঁধা পড়ে থাকে? বিশ্বাসের সুতো ছিঁড়ে গেলেও আবার জুড়ে নিয়ে প্রবোধের পথে হাঁটে?
তিন.
জন্মের পর অধিকাংশ শিশুর মস্তিষ্কে প্রথম যে তারকাঁটা টেনে দেওয়া হয় তা হলো, পরিবারের মানুষগুলো ছাড়া জগতে বাকি সবাই স্বার্থপর, ক্ষতিকারক, ভীতিকর। ‘রক্তের সম্পর্ক’ এটা একটা ব্যাপার। এর বাইরের সম্পর্কগুলো যেন কেবল জীবনের অতিথি। কিন্তু যখন দেখি জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে, জরা-ব্যাধিতে প্রিয় বন্ধুটি, পাশের ফ্ল্যাটের মেয়েটি, অনেক দিনের পরিচিত আপা বা ভাইটি সবার আগে ছুটে আসেন, লড়াই করেন, রাত-দিন আমার সঙ্গে তাঁদের কপালেও পড়ে চিন্তার ভাঁজ। কিন্তু রক্তের সম্পর্কের তেমন কেউই এই হৃৎপিণ্ডের গতি বুঝতে পারে না, তখন সেই তারকাঁটা ছিঁড়ে চিৎকার করে জানান দিতে ইচ্ছে হয়, এই পৃথিবীই আমার বাড়ি, এরা সবাই আমার পরিবার। জীবনের প্রতিটি বাঁকেই কেউ না কেউ রয়েছেন ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, সাহায্য়ের হাত বাড়িয়ে।
চার.
খেয়াল করে দেখলাম, আমাদের আত্মিক লোকে কিন্তু পরিবার, পরিজন, বন্ধু বা পরিচিত সব লোকের চলাচল করতে আমরা দেখি না। আত্মিক লোকে যখন আমরা লোক গিজগিজ বাজার বা রেলস্টেশনেও দাঁড়াই, তখন কিন্তু অস্পষ্ট সব মুখের মধ্যে সেসব মানুষের পরিষ্কার মুখ আমরা দেখি, যাঁদের কোনো না কোনোভাবে আমরা চাই, কোনো না কোনোভাবে সেই মানুষটি আমাদের প্রাণ ছুঁয়ে আছেন। আমরা যাঁদের বুঝতে পারি না বা আমরা যাঁদের বোধগম্য নই, তাঁদের কি সেই অজ্ঞাতবাসে দেখতে পাই? কেউ একজন বলেছিলেন, আত্মিক সম্পর্কে কখনো ছেদ হয় না। আসলেই তো তাই। যাঁদের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তাঁরা দূরে গেলেও মনে হয় যেন স্পর্শ করেই আছেন। আর কোথাও না হোক, অজ্ঞাতবাসে দেখা মিলবেই। এই আনন্দলোকে কোনো ভাঙন নেই, বিচ্ছেদ নেই, কোনো অবহেলা নেই, কোনো অবজ্ঞা নেই। শুধু প্রেম আর প্রেম। এই অজ্ঞাতবাস, এই কল্পস্বর্গ না থাকলে জগতের কত কত মানুষই না প্রাণ থেকেও প্রাণ হারাত। এই কল্পস্বর্গের অধিবাসীদের প্রেম না থাকলে জাগতিক এত অবহেলাকে দুচ্ছাই বলাও তো চাট্টিখানি কথা ছিল না, তাই না? প্রেম আছে, জগতের কোথাও না কোথাও প্রেম আছে।
সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা